
সবাই জানতে চায় কিউবার কথা, কেমন আছে সেখানকার অধিবাসীরা, কেমন চলছে সেখানের জীবনযাত্রা। জীবন কি পিছিয়ে গেছে সেখান না এগোচ্ছে বাকী বিশ্বের সাথে সমান তালেই। প্রায় একই কৌতূহল সবারই, যেমন একজন মার্কিনীর, তেমন একজন বঙ্গবাসীরও। আর এর পিছনে মূল কারণ কিন্তু সঠিক তথ্যের বিরল উপস্থিতি এবং অপর্যাপ্ততা।
বিশ্বের দুই প্রভাবশালী মহলের প্রোপাগান্ডা মেশিনের কবলে পড়ে ১০০ ভাগ বিপরীত তথ্যের স্রোতে আমরা জানতে পারি না সত্যটা, আমেরিকান প্রেসের কথা শুনলে মনে হয় গত ৫০ বছর ধরে কিউবা পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র রাষ্ট্র, সেখানে মানুষের অভাব নিত্তনৈমিত্তিক, ক্ষুধায় মৃত্যু তো প্রতিদিনকার ঘটনা, আবার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রচার যন্ত্রের খবর পড়লে মনে হত কিউবা পৃথিবীর শেষ স্বর্গ, এখানকার প্রতিটি মানুষ হো চি মিনের মত একজন সাচ্চা বিপ্লবী, যাদের কাছে নিজের চেয়ে দেশ বড়, পরিবারের চেয়ে সমাজ বড়। এখন বিশ্বাস করি কোনটাতে?
বিশাল দ্বীপ দেশ কিউবা, মাত্র ১৫ দিনের এর একাংশই দেখা সম্ভব না, তারপরও চরকির মতে ঘুরে উল্লেখ যোগ্য কিছু জনপদসহ প্রায় অর্ধেকের বেশী দেখে ফেলেছিলাম আমরা, অবশ্যই সে দেখা গভীর কিছু নেই, আর এত অল্প দিনে এমন আশা করাও অন্যায়। তাই এই লেখাতে সেই তাড়াহুড়ো করে দেখা ও লেখার পক্ষপাতিত্ব অবশ্যই থেকে যেতে পারি, কিন্তু সেই অদেখা জীবন নিয়ে লিখতে দোষ কিসের!
তবে একটা কথা প্রথমেই পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল, মানুষ সবসময় সব কথাই বলে আপেক্ষিক হিসেবে বা তুলনা করে, যেমন আজ দারুণ রোদ ( মানে গতকালকের তুলনায়), বেশ ভাল আছি (আগের তুলনায়) তাই কিউবার সমাজ ব্যবস্থার সাথে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই কোন না কোন দেশের তুলনা আসবে কিন্তু কোন দেশের-
আমি গিয়েছি ফিনল্যান্ড থেকে, ফিনল্যান্ড ২০১০ সালে নিউজউইক পত্রিকার হিসাব মতে বিশ্বের সবচেয়ে বসবাসযোগ্য দেশ নির্বাচিত হয়েছিল, কিন্তু সারা বিশ্বে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার ৪ টি দেশের ব্যাপার খানিকটে আলাদা, এদের বিশাল দেশ, জনসংখ্যা অতি অল্প, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও খুব কম, এদেশগুলোতে বসবাসরতরা জানেন এইখানেই প্রকৃত গণতন্ত্র বা মুক্ত সমাজতন্ত্র ( সোশ্যালিজমের চর্চা হয়ে আসছে অনেক বছর ধরে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমেই), মানুষের মত প্রকাশের অধিকার অত্যন্ত বেশী, সেই সাথে দুর্নীতির হার সবচেয়ে কম।
তাই এই অঞ্চল না, কিউবার তুলনা আমি করব ৫ দশকের আগের কিউবার সাথে, তার প্রতিবেশী দেশসমূহ- হাইতি, জ্যামাইকা, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। এবং বারংবার বাংলাদেশের সাথে, কারণ প্রায় একটি দ্রাঘিমাংশে অবস্থানের পরেও কিউবা এবং বাংলাদেশ আমাদের গ্রহের দুই প্রান্তে উপস্থিত হলেও, বাংলা নামের দেশটাতে জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে আমার, এই দেশটাকেই চিনি সবচেয়ে ভাল ভাবে।

জানিয়ে রাখি, কিউবায় দুই ধরনের টাকার প্রচলন বিদ্যমান। কিউবাবাসীদের জন্য কিউবান পেসো আর পর্যটকদের জন্য পরিবর্তনযোগ্য কিউবান পেসো, যাকে তারা বলে কনভারটিবল, বা কুপস। ট্যুরিস্টদের সব খরচ কুপসেই করতে হয় এবং তাদের জন্য যে কোন কিছুর খরচই স্থানীয়দের চেয়ে অনেক অনেক বেশী।
প্রথমেই আসি ভিসার কথায়, কিউবার ভিসা প্রদানের নিয়ম পৃথিবীর যে কোন দেশের চেয়ে সহজ, কেবল পাসপোর্ট থাকলেই হয় ! সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে দেশ বিদেশে ভ্রমণের জন্য কি যে হাঙ্গামা পোহাতে হয় তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন ( মাত্র এই মাসেই পেরু আর মেক্সিকোর ভিসার জন্য কেবল আঙ্গুলের ছাপই নয়, পুলিশের কাছ থেকে নিজের নামে যে কোন অপরাধ নেই, এই সার্টিফিকেট পর্যন্ত তুলে দিতে হয়েছে!)। সেই দিক দিয়ে কিউবার ভিসা ভারতের ভিসার চেয়েও বিলিয়ন গুণ বেশী ঝামেলা মুক্ত ও সহজ। অ্যাম্বাসীতে যাবার মিনিট পনেরর মধ্যেই ভিসা মিলল হাতে-নাতে। কিউবার ভিসা অবশ্য পাসপোর্টে লাগিয়ে দেয় না, বরং দুই ভাগে ভাগ করা একটা কাগজ দেয়, একটি দেশটিতে নামার পরপর ইমিগ্রেশন অফিস রেখে দেয়, অন্যটি ফেরার সময় ফেরৎ দিতে হয়।
সেই সাথে আগেই শুনেছিলাম বিশ্বের যে দেশটিতে লিঙ্গবৈষম্য, বর্ণবৈষম্যের স্থান সবচেয়ে কম তার নাম কিউবা। এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন অফিসারদের সবাইই ছিলেন নারী, এবং অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ নারী! আচ্ছা ধরে নিলাম, পর্যটকদের আই ওয়াশের জন্য এমনটি ইচ্ছে করে রাখা হয়েছে, কিন্তু দেশটির আনাচে কানাচে ঘুরে কিন্তু এমনটি মনে হল না, স্বল্পবসনাদের সাবলীল আচরণ প্রমাণ করে নারীদের রক্ষায় আইন যেমন সচেষ্ট, তেমনি সচেষ্ট তারা নিজেরাও।


সেই সাথে হাভানা কার্নিভ্যালের ছবি দেখে জনৈক পাঠক জানতে চেয়েছিলেন, সেখানে ইভ টিজিং কেমন হয় ? উত্তরে এখানে বলছি- আমার জানা মতে সেখানে ইভ টিজিং শব্দটি অপরিচিত।
কিউবার মত সবুজে ছাওয়া দেশ অতি বিরল, মাইলের পর মাইল অবারিত অপাপবিদ্ধ নিষ্কলঙ্ক নিসর্গ। সেই সাথে প্রায়ই দর্শন মেলে বিশাল সব মহীরুহের। অনেক জায়গাতেই যেন বনস্পতির মিলন মেলা। এই ব্যাপারে এই স্থানীয়কে প্রশ্ন করতেই জানালো- কিউবাতে অনুমতি ছাড়া গাছ কাটার নিয়ম নেই! কেউ লুকিয়ে চুরিয়ে গাছ কাটলেই পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে!

এক গোধূলির কথা তো সারা জীবন মনে থাকবে-
ভিনিয়ালেসে এক বিকেলের ক্রান্তীয় ঝড়ের পরে আকাশের মনের ভার কেটে ঝকঝকে রোদ্দুরময় আকাশের দর্শন পেয়ে বৈকালিক পদব্রজেই বাহির হলাম বুকে হাঁপর ভরে ঝুম বৃষ্টিপাতের পরে মাটি থেকে উঠে আসা সোঁদা গন্ধ নিতে, বাড়ীওয়ালা ডাক্তার রিডেলের ছোট্ট মেয়ে লাওরা আমাদের সঙ্গী নিয়ে গেল পাড়া বেড়াতে, নিসর্গ চারিদিকেই এখানে। গ্রামবাংলার মত ছোট পুকুরের চারপাশে নারকেল গাছের সারি, কচুক্ষেতের মতই এক সবুজ সব্জির ক্ষেত, পাশের বাঁশঝাড় থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে পদ্মনীল কালেম পাখির ডাক, সেই পাখি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে করতেই দেখা হল স্থানীয় এক কিষাণের সাথে, ইয়া তাগড়া এক জোড়া মহিষকে গোধূলি বেলায় জল খাওয়াতে নিয়ে এসেছে সেই পুকুরে বাড়ী ফেরার আগে। চোখাচোখি হতেই, সন্মান দেখিয়ে হ্যাটটা ঝুকিয়ে বলল বুয়েনোস তারদেস আমিগো ( শুভ সন্ধ্যা, বন্ধু)
তারপর বেশ অবাক করেই আমাকে ইংরেজি তাদের মহিষ দুটি দেখিয়ে বলল, মাই ট্র্যাক্টর। কারণ গ্রামাঞ্চলের মানুষেরা সাধারণত এখানে ইংরেজি বলে না যদি না তারা পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত থাকে, এর পরে সে আমার সমগ্র জানা বিশ্বকে স্তম্ভিত, লজ্জিত, দুঃখিত করে আরও দুটি শব্দ বলল ইংরেজিতে, আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস হল না যখন শুনলাম পায়ের বুটে লাল কাঁদা লেপটে থাকা কৃষক মুখে প্রভাত সূর্যের মত ঝলমলে হাসি নিয়ে বলল, ভেরি ইকোলজিক্যাল !
এখনো শুনি বাংলাদেশের শতকরা আশি ভাগ জমিই ধান ক্ষেত, আচ্ছা দেশের কথা ছাড়লাম- পাশের অন্যান্য কৃষিপ্রধান দেশগুলি- ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এমনকি খোদ চীনের কোটি কোটি কৃষকতো বাদই দিলাম, সেইসব দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যারা, সেই মন্ত্রীদের ক,জনা ইকোলজিক্যাল বা পরিবেশবাদী শব্দটার আসল অর্থ জানে ??

জানে না, এবং মানে না। সেই অস্তগামী সূর্যের চুরি যাওয়া আলোয় কিউবার এক নাম না জানা কৃষক আমাকে জানিয়ে দিল সারা গ্রহ ধবংসের দিকে স্বেচ্ছায় এগোলেও তারা এগোবে না , তারা থাকবে এই পরিবেশবাদী প্রাচীন কিন্তু অজর, অমর, অক্ষয় প্রথা অবলম্বন করেই।

যে কারণে তারা যেমন পরিবেশদূষণকারী যন্ত্রের সাহায্যে জমি মাড়াই করে না, ঠিক তেমনি জমিতে ব্যবহার করে না কোন কীটনাশক না রাসায়নিক সার। আর একবার এই ক্ষতিকারক তথাকথিত উচ্চ ফলনে সাহায্যকারী এই রাসায়নিক দ্রব্যগুলো ব্যবহার করলে জমি যে অতি দ্রুত তার উর্বরতা হারিয়ে তাদের উপরই নির্ভর হয়ে পড়ে এর প্রমাণ বাংলাদেশ।

এর আগে তো বলেছিই তাদের জীব বৈচিত্র্য এবং সেটি রক্ষায় জনসাধারণের ভুমিকার পেছনে সরকারের শিক্ষানীতির অবদানের কথা। যে কারণে, কিউবা ছেলে বুড়োরা কেউই গিরগিটি হত্যা করে না, উপকারি প্রাণী বলে।

সেই সাথে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনটি সরকার কিভাবে রক্ষা করেছে তা ছিল জাপাতার গল্পে।
তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব বা উন্নয়নশীল বিশ্ব বললেই অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসে পথ শিশুদের কথা, দেশের সরকার আসে, যায়, কিছু ,মানুষের আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়, কিছু মেধাবী দরিদ্র মানবসন্তান কিছুটা সাচ্ছল্যের মুখ দেখে মেধা বিক্রি করে, কিন্তু কচুরিপানার মত শেকড়হীন এই শিশুসমাজের ভাগ্যের কালো আকাশে পরিবর্তন আসে না কোন। টোকাইরা বড় হয়ে জড়িয়ে পড়ে অপরাধজগতে, না হয় বেছে নেয় শ্রম বাজারে আধুনিক দাসত্বের জীবন। যারা বলে ভারত দুর্দান্ত গতিতে অর্থনৈতিক উন্নতি করছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ১০ ব্যক্তির মধে একাধিক ভারতীয়, মুম্বাই- দিল্লীর ঠাটবাটই আলাদা। কিন্তু চোখ খুলে তাদের দেখতে বলি, দিল্লী, কোলকাতা, মুম্বাইতে নতুন চকচকে গাড়ীর চেয়ে নিযুত গুণ বেশী অনাহারে শীর্ণ আজন্ম দুঃখ লেপটানো মুখে সারি সারি পথশিশুরা।
এত কথা বলার একটাই কারণ, কিউবাতে পথশিশুদের কোন অস্তিত্ব নেই ! এটি কোন রূপকথার স্বর্গরাজ্য নয়, কিন্তু মাত্র কয়েক দশকের গৃহীত ব্যবস্থার ফলে সব শিশুর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে শতকরা একশ ভাগ। তাদের দেখবেন না কেউ কিউবার কোন অজগ্রামে বা অট্টালিকাময় মহানগরীতে।
আসি নিরাপত্তার কথায়- কিউবার রাজধানী হাভানা কেবলমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজের নয়, উত্তর বা মধ্য আমেরিকার নয়, ল্যাতিন আমেরিকার নয়, বরং সমগ্র আমেরিকার নিরাপদতম মেট্রপলিটন শহর। এখানে এমন কোন জায়গা নেই যেখানে পর্যটকদের একলা চলাচল করতে নিষেধ করা হয়েছে! আমি নিজেই গলায় দামি ক্যামেরার সাথে তারচেয়েও দামি লেন্স এঁটে যত্রতত্র, যখন তখন ঘুরে বেরিয়েছি, রাতের আধারেও, এই সাহসটা ঢাকাতে কোনদিনই করব না।

একজন অবশ্য জানালো, কিউবা আর আগের মত নেয়, কমাস আগে সান্তিয়াগো দ্য ক্যুবাতে ( অন্যতম বৃহত্তম শহর, কবি হোসে মার্তির জন্মস্থান) সুইডিশ এক দর্শনার্থীর ক্যামেরা ছিনতাই হয়েছে ছুরির মুখে। আমি বললাম, আরে বাবা, তোমাদের এই দ্বীপ দেশে বছর ২০ লক্ষ পর্যটক আসে! ২০টা এমন ঘটনা ঘটতেই পারে! যাও না কিউবার প্রতিবেশী দেশগুলোতে- হাইতি, সেন্ট ডমিনিক কিংবা জ্যামাইকায়! কিছু না হারিয়ে, নিজের কাপড় নিয়ে ফিরতে পারলেই যেখানে খুশি হয় মানুষজন।


কেমন ছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রোর আগের কিউবা? স্পেনের কাছ থেকে সশস্ত্র সংগ্রামে স্বাধীনতা লাভের পরপরই আমেরিকার অপরাধজগতের শীর্ষ নেতা এবং রাজনীতিবিদদের এক ধরনের উপনিবেশেই পরিণত হয়েছিল কিউবা, তাদের অঙ্গুলি হেলনেই সরকারে বসত তাবেদার উর্দি পরা সামরিক শাসক ( গডফাদার চলচ্চিত্রের ২য় পর্ব দেখতে পারেন)। দেশে ছিল প্রচুর পানশালা, অভিজাত হোটেল, ক্যাসিনোর ছড়াছড়ি আর বরাবরের মতই সক্রিয় অপরাধচক্র। সস্তা মদ, নারী মাংস আর মাদকের বাজারের সাথে সাথে চোরাচালানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়ে ছিল দ্বীপটি, সমস্ত ক্ষমতা আর সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছিল গুটিকয় পরিবারের হাতে।

মাঝে মাঝেই গর্জে উঠেছে আমজনতা, কিন্তু বুলেট, বুট আর নির্বাসন দিয়ে স্তব্ধ করার চেষ্টা চলেছে সর্বদাই, সেই গল্প বলেছিলাম কিউবার বিপ্লবের জাদুঘরে। শিক্ষার হার ছিল তথৈবচ। চিকিৎসার বালাই ছিল আর দশটি অনুন্নত দেশের মতই। সোজা কথায় দেশটা ছিল মার্কিনীদের শুঁড়িখানা আর বেশ্যাখানা।
ফিদেল আর তার আদর্শে উজ্জীবিত অনুসারীদের হাতে নিশ্চয়ই আলাদীনের চেরাগ নেই, কিন্তু কি জাদু বলে একরত্তি এই দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর সার্বক্ষণিক অসহযোগিতা ও বিরোধিতা স্বত্বেও আজ তারা শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সমগ্র আমেরিকার শীর্ষ স্থানটি দখল করে আছে জানতে ইচ্ছা করে, বুঝতে ইচ্ছে করে।

আগেই বলে নিচ্ছি, আমেরিকার বিরোধিতা করবার জন্য এই লেখাটি নয়, বিশ্বের আর দশটি দেশের সরকারের মত আমেরিকারও বহু ভাল কাজ রয়েছে, তেমন রয়েছে ছাপা অযোগ্য অনেক নিন্দনীয় অপরাধ। পাঠকরা কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন আজকের বিশ্বের আমেরিকা বা ইসরায়েলের মত মহা শক্তিধর রাষ্ট্র না থাকলেই কিন্তু রাষ্ট্র বিশেষের হানাহানি বা মোড়লপনা বন্ধ হত না, কোন না কোন দেশ এই জায়গা দখল করে তাদের দখলদারিত্ব ভিন্ন ভাবে ঠিকই চালিয়ে যেত। আপনারা কি মনে করেন চীন যদি ভবিষ্যৎ বিশ্বের কর্ণধার হয়, অবস্থা এর চেয়ে ভাল হবে?
ক্ষমতার ব্যপারটা দুঃখজনক ভাবেই আলাদা, অন্যদের কাছে যাব না, নিজেদের কথাই বলি- বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে অতি দুর্বল একটা দেশ, জাতিসংঘে সেনা পাঠানো বাদে আমাদের কোন অস্তিত্বই নেই বহির্বিশ্বের রাজনিতিতে ( আমাদের রাজনীতিবিদ আর তথাকথিত তৈলমর্দনকারী বুদ্ধিজীবীদের কথায় ভুলেন না কোন সময়), সেই আমরাই আমাদের দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে প্রায় মানুষই মনে করি না পাহাড়ে সমতলে বসবাসকারী পঞ্চাশটির উপরে আদিবাসী গোত্রকে! কোন সময়ই শিক্ষিত মানুষেরাই চিন্তা করে না, একজন চাকমা, মারমা, বনযোগী শিশুর মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের প্রয়োজন আছে! মোদ্দা কথা, ক্ষমতার কাঙ্গাল সব রাষ্ট্রযন্ত্রই, সবাইই চাই অন্যের মাথায় ছড়ি ঘোরাতে,
আজ আমরা বুশ-ওবামার দোষ দিয়েই যাচ্ছি, অবশ্যই তারা অপরাধী, কিন্তু সেই সাথে যেন একটু চিন্তা করে দেখি একজন সাদ্দাম, গাদ্দাফি, মোবারক, কিম জং ইল আমেরিকার রাষ্ট্রপতির তুলনায় ২ % ক্ষমতা না থাকলেও যে তান্ডবলীলা চালিয়েছে নিজের দেশবাসীর উপরে, ১০০% ক্ষমতা বিশেষত বিশ্বশাসনের ক্ষমতা থাকলে কি যে হত ভাবতেও ভয় হয়।
আসি চিকিৎসার কথায়, যারা বিশ্বখ্যাত চিত্রপরিচালক মাইকেল মুরের সিকো তথ্যচিত্রটি দেখেছেন তারা ভালই অবহিত আছেন কিউবার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে, যারা দেখেন নাই তাদের জন্য বলি কিউবায় আছে বিশ্বের সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার হাসপাতালগুলোতে, এবং জনসংখ্যা প্রতি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী ডাক্তার কে দুটি দেশে সবচেয়ে বেশী তার একটি কিউবা, অন্যটি ইসরায়েল ( এই প্রসঙ্গে বলতেই হয় ইসরায়েল কোন রাষ্ট্র নয়, এটি একটি ক্ষুদে পৃথিবী, সারা বিশ্ব থেকে ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা চাইলেই ইসরায়েলে যেয়ে বসতি স্থাপন করতে পারেন, তাদের অনেকেরই ডাক্তার বা দক্ষ পেশাজীবী হয়ে ওঠার ইতিহাস অন্য দেশের পয়সায়, শ্রমে। কিউবার সাথে তাদের তুলনা কোনভাবেই হয় না।
এবং কিউবা সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশে যারা ডাক্তার রপ্তানি করে থাকে, আমাদের আশ্রয় প্রদানকারী একাধিক বাড়ীতে দেখাছিলাম সেই পরিবারের সদস্য ডাক্তার হিসেবে ভেনেজুয়েলা বা অন্য দেশে কর্মরত। এবং আরও আশার কথা, আগামী ৫ বছরের মাথায়ই এই মোট ডাক্তারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে বলি, আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ বিশ্বের তথাকথিত ধনী রাষ্ট্রগুলো কিন্তু বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে বিপর্যয়ের পরে ঔষধ, খাবার অন্যান্য ত্রান সামগ্রী পাঠালেও ডাক্তার পাঠাতে সক্ষম হয় না, কারণ তাদের নিজেদের নাগরিকদের জন্যই পর্যাপ্ত ডাক্তার নেই।
সেই সাথে এদের গড় আয়ু দুই আমেরিকা মহাদেশ মিলিয়ে সবচেয়ে বেশী, মহিলাদের ৮২, পুরুষদের ৭৬ ! এবং কেবল টিকে থাকা নয়, সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকা!

এমন উন্নতি কি করে সম্ভব হল মাত্র কয়েক দশকে !
২০০৬ সালে WWF ( World Wildlife Fund) এর জরিপে বিশ্বের সেরা sustainable দেশ ( এর যথার্থ বাংলাটি জানা নেই) হিসেবে নির্বাচিত হয়, সত্য কথা বলতে একমাত্র সাসটেইনেবল দেশ হিসেবে প্রশংসা কুড়ায় সকলের। এখানে বলা হয়েছিল, তথাকথিত ধনী দেশগুলোর জনসাধারণ প্রয়োজনের এত অতিরিক্ত সম্পদ অপব্যয় করে যে পরিবেশের ক্ষতি হয় মারাত্নক, আবার দরিদ্র দেশগুলোতে বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ায়, জনগণের নুন্যতম মৌলিক অধিকারও সংরক্ষিত হয় না । কিউবা এর একমাত্র ব্যতিক্রম! আশ্চর্যজনক ভাবে, এরা পরিবেশ রক্ষায় যেমন অগ্রগামী, ঠিক তেমনি সচেষ্ট জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায়, কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত অপব্যয় রোধে।

হাভানার বেশ নামী এক ক্রিকেট দলের কোচের সাথে আলাপচারিতার সৌভাগ্য হয়েছিল, জেনেছিলাম কিউবায় ক্রীড়াকে পেশা হিসেবে নিয়ে অর্থ উপার্জনের কোন সুযোগ নেই। যে যে ভাবেই নিন আমি এটা প্রচণ্ড ভাবে সমর্থন করি ( যদিও অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে, বহু দিনের সঞ্চয় উড়িয়ে দু-দুবার ফুটবল বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়া আমার মুখ এই কথা হয়ত মানায় না, কিন্তু নিজে করলেই যে ঠিক এমন কথা কে বলেছে! ) একটু ভেবে দেখুন- সমাজের কি উপকারটা করে যে কোন ক্রীড়াবিদরা ! ক্রীড়াবিদ মানেই বিনোদনদানকারী, যার কসরত বা সামর্থ্য দেখে উল্লসিত হবে দর্শকরা।
নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্যিক নাদিন গার্ডিমার যেমন বলেছিলেন স্বদেশে আয়োজিত বিশ্বকাপ নিয়ে- ফুটবল বিশ্বকাপ খুব ভাল সার্কাস, এর প্রয়োজন আছে কিন্তু সমাজের কি কাজে আসে এত ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান বা স্টেডিয়ামগুলো! বন্ধুরা, একটু চিন্তা করে দেখুন, ক্রীড়াবিদরা সমাজের অতি প্রয়োজনীয় না বলেই হয়ত ইতিহাস তাদের মনে রাখে না, যেমন প্রাচীন অলিম্পিকে নিশ্চয়ই অনেক নামকরা, চতুর্দিকে সন্মান ছড়ানো ক্রীড়াবিদ ছিলেন, তাদের কারো নাম কি আমরা জানি! জানি না, কিন্তু আমরা মনে রেখেছি হোমার নামের এক অন্ধ ভিখারিকে, ইশপ নামের এক ক্রীতদাসকে।
আজকের পৃথিবীতেই যারা ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, সাঁতার, টেনিস- অসংখ্য খেলা দিয়ে বিশ্ব মাতিয়ে রাখছেন, তারা কি মাত্র কয়েক বছরের মাঝে বিস্মৃতির দেয়ালে চাপা পড়ে যান না! তারা কি দিয়ে যান আমাদের সমাজকে, মানব সভ্যতাকে! একজনে লিওনেল মেসি বা ক্রিস্তিয়ানো রোনালদো না থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত আমজনতার নাকি ক্ষতি হত এই খেলাকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন বিলিয়ন ডলারের জুয়ার আয়োজন করা মাফিয়া চক্রের! বাংলাদেশের মত দেশে কোন হিসেবে একজন আশরাফুল বা সাকিব আল হাসান কাড়ি কাড়ি টাকা আয় করে কেবল মানুষদের কয়েক মুহূর্তের বিনোদন দিয়ে, আমরা কি আসলেই বিনোদন পাচ্ছি, না এটি আমাদের উপরে একটি মহলের চাপিয়ে দেয়া ব্যবস্থা যারা ধোঁয়া তুলে Eat Criket, Drink Criket নামে!
কিউবান সরকারের এই ব্যাপারে দর্শন অত্যন্ত স্বচ্ছ, ক্রীড়াকে ক্রীড়া হিসেবেই নাও। ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যাও দেশের প্রতিনিধি হিসেবে, সন্মান কুড়িয়ে নেও পারলে জয়ী হিসেবে, কিন্তু তুমি সমাজের একটি অংশমাত্র, বিজয়ী হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান কর না! কিন্তু তাদের উৎসাহতো ঠিকই আছে দক্ষ ক্রীড়াবিদ গড়ার ক্ষেত্রে- বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা মুস্টিযোদ্ধা, তিন তিন বার অলিম্পিকে সোনা জয়ী ফেলিক্স সাভোন এই দ্বীপদেশেরই নাগরিক, তাদের ভলিবল দলের লড়াকু মনোভাবের জন্য সমর্থনের অভাব হয় না কখনোই, সবচেয়ে বড় কথা কোন বহুজাতিক কোম্পানির অর্থায়ন ছাড়াই এক লক্ষের উপরে নিয়মিত ক্রীড়াবিদ রয়েছে কিউবার, কেবলমাত্র বিনোদনের টানে, খেলার আকর্ষণের টানে।
কিছুই কি খারাপ চোখে পড়েনি কিউবায় স্বল্পকালীন অবস্থানের সময়! দেখুন, আপনি যদি ভাল খুজতে চাল তাহলে ভাল পাবেনই, আর খারাপ চাইলে সে তো আরও বেশী সহজ।
কিউবাতে সবচেয়ে বেশী বিরক্ত লেগেছে হাভানার অনেক জায়গাতে লোকজনের সিগার কেনার জন্য আহ্বান, শালীনতা বজায় রেখেই, কিন্তু বারংবার , ঐ বন্ধু, চুরুট কিনবে নাকি, শুনতে কার ভাল লাগে !
সেই সাথে একমাত্র হাভানাতেই বেশ কজনের সাথে পরিচয় হল, যারা যেচে এসে পথ দেখিয়ে শেষে একটাই গল্প ফেঁদে বসে- বাড়ীতে দুগ্ধপোষ্য শিশু আছে, দুধ কেনার পয়সা নেই, যৎসামান্য দান চায় দুধ কেনবার জন্য! অন্য কোন শহরে এমনটা হয় নি, কিন্তু হাভানায় এত বেশী বার ঘটতে লাগল, শেষের দিনগুলোতে কেউ নিজে থেকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেই এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতাম।
আমাদের আশ্রয়দাতা একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বলেছিলেন, দেখ আমাদের বেতন খুব কম। কত বেতন? ৩০ ডলার ! খুবই শঙ্কার কথা, অন্য দেশে যেখানে কয়েক হাজার ডলার কমপক্ষে তার বেতন হবে সেখানে স্বদেশে মাত্র ৩০ ! জিজ্ঞেস করলাম, কিউবার রাষ্ট্রপতির বেতন কত- জানা গেল সেই ৩০ ডলার!!
তারপর বললাম, তাহলে আফসোস করছ কেন! তোমার আর রাষ্ট্রপ্রধানের তো একই বেতন, আর তোমার বাচ্চাদের শিক্ষা, চিকিৎসা যাবতীয় সবকিছুর ভার তো রাষ্ট্রের! সে সবজান্তার ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে বলল, আরে বাবা, বুঝতে চেষ্টা কর! আমাদের জীবন ধারনের প্রয়োজনীয় সবকিছুই সরকার দিয়েছে, কিন্তু আমারও তো ইচ্ছে করে একটা গাড়ীর মালিক হতে, তোমাদের মত ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে বিদেশ ঘুরতে! এটা তো এইদেশে সম্ভব না! ( স্থানীয়দের জন্য ভ্রমণ প্রায়শই অকল্পনীয়, সেই পরিমাণ অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে না কখনোই )

আমার মনে হয়েছে কিউবার তরুণ প্রজন্ম এই মতের অনুসারি, সরকারের আদর্শের বিরুদ্ধে তারা নয়, কিন্তু তারা দেখে চুপিসারে আমেরিকা পাড়ি দেওয়া প্রতিবেশী বা আত্মীয় বছর কয় পরপর এসে চোখের সামনে দামি গাড়ী হাকিয়ে, ঝলমলে পোশাক পরিধান করে, গলায় সোনার চেন ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে বিপ্লবের বিরুদ্ধে নয় কিন্তু তারও ইচ্ছে করে দরকার হলে আমেরিকায় যেয়ে বাথরুম ঘষে হলেও নিজের একটি গাড়ীর মালিক হতে।
এক বাড়ীর মালিক জানালেন যেহেতু কিউবার সব অফিসে বেতন নির্দিষ্ট, যে পরিমাণই কাজ কর, তাই মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাজের প্রতি নজর কম, অনেকেই দায়সারা ভাবে অফিসে যায় অনেক দেরী করে, কোনমতে সময়টুকু পার করে চলে আসে। এখানেই ঘুরে ফিরে আসে সেই মানবজাতির মজ্জাগত স্বার্থপরতার কথা, ম্যাকিয়া ভেলির রাজকুমারের মত লাভের লোভ দেখিয়েই কাজ করিয়ে নেওয়া যায় অধিকাংশ মানুষকে, আদর্শের বাণী আটকে থাকে বইয়ের পাতায়।
ভিনিয়ালাসের এক তামাক চাষি জানিয়েছিলেন উৎপাদিত ফসলের ৯০ % সরকারকে দিতে হয় তার, যে কারণ উৎপাদন বাড়াবার তাগিদ পায় না সে ভিতর থেকে। আমি বলেছিলাম- জমির মালিক কে? রাষ্ট্র! আচ্ছা, বীজ, জৈব সার , সেচ ব্যবস্থার টাকা দেয় কে? সরকার! আচ্ছা , কোন কারণে যদি দুর্ঘটনায় ফসল ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে? উত্তর- তাহলে আর কি! সরকার আমাদের দেখভাল করবে !
আরে বাবা, এত বিপদে সরকার পাশে দাঁড়াবে, তো তাকে ফসলের ভাগ গিতে তোমার সমস্যা কি! কিউবাতে প্রচলিত ব্যবস্থার সমালোচনা অনেকে করলেও কেউ বলেনি ফিদেল বা তার মন্ত্রী পরিষদের কেউ দুর্নীতি করে অর্থ সম্পদ গড়েছেন, বা সেখানকার পুলিশ আর রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিবাজ!!
হ্যাঁ, দুর্নীতি আছে সেখানে, সর্বত্রই, কিন্তু অন্য ধরনের। যা চোখে পড়েছে প্রতিদিন। কোন দিন এক হাত লম্বা লবস্টার খেতে চেলাম, ব্যস রাতে পাতে হাজির। কোথা থেকে এল? স্থানীয় কোন জেলে ধরে ছিল সকালে, খবর পেয় দিয়ে গেল। কিন্তু সরকারকে বা তার প্রতিনিধিদের জানাবে না। জানালে রাষ্ট্রের অংশ দিতে হবে যে ! এমন ভাবে, সাধারণ জনগণের বিশাল অংশ- মাছ, মাংস, মুরগী, চাল, শিম এমনকি হোটেলের কক্ষ নিয়ে পর্যন্ত অন্য ধরনের চোরাকারবারি চালিয়েই যায়।
টিকবে কি কিউবার এই সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা, যেখানে সবাই সমান অধিকারের অধিকারী! মনে হয় না, কারণ বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ একভাবে চিন্তা করে না, কারণ মানুষ জন্মগত ভাবেই অত্যন্ত স্বার্থপর প্রাণী। আমাদের সামনে আদর্শ হিসেবে দাড়িয়ে থাকেন একজন চে আর্নেস্তো গুয়েভারা, আর্জেন্টিনায় জন্ম গ্রহণকারী অসাধারণ প্রতিভাবান এই ডাক্তার দূর দেশ কিউবার জন্য জীবনপাত করে লড়াই করে দেশটিকে আসল স্বাধীনতা দান করলেন, দেশটির মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হলেন। কিন্তু তার আদর্শচ্যুত হলেন না, নিজেকে আমজনতার একজন মনে করেই সপ্তাহে ৬ দিন দাপ্তরিক কাজের পরও ছুটির দিনে আঁখ ক্ষেতে বা চিনির কলে মজুরের কঠোর পরিশ্রম করতেন স্বেচ্ছাশ্রমের অংশ হিসেবে ( কিউবায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনে, রবিবারে কে কেউ নানা ধরনের স্বেচ্ছাশ্রমে অংশ নিতে পারেন, যেমন শহরের রাস্তা পরিষ্কারের কাজে ) এবং অন্য মন্ত্রীদেরও এই ব্যপারে অংশ নিতে উৎসাহিত করতেন। কিন্তু ফল হল বিপরীত, কিউবান অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই রুখে দাঁড়ালেন এর বিরুদ্ধে! জানালা, বিপ্লব সফল করেছি, এই অনেক, এখন বিশ্রামের সময় ! এই শ্রমপাগল আর্জেন্টাইনের মন্ত্রে মেতে ওঠার সময় আমাদের নেই। যে চে অসুস্থ সন্তানকে মন্ত্রী থাকা অবস্থায় গাড়ীতে করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বলেছিলেন , আমাকে গাড়ীর তেল দেওয়া হয় কেবলমাত্র দাপ্তরিক কাজে জন্য, ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যবহারের জন্য না। আর আমার সন্তান অসুস্থ হলে কিউবার আর দশ জন শিশু যেভাবে ডাক্তারের কাছে যায়, সেও সেই ভাবেই যাবে !
কিন্তু বিশ্বের কয় জন মানুষ এই ভাবে সত্যিকারের সাম্যবাদে বিশ্বাস করেন ও ব্যক্তিগত জীবনে তার প্রতিফলন ঘটান??? মুশকিল টা এইখানেই, অধিকাংশ মানুষই ঘটান না, যে কারণে এই মহান মানুষদের অর্জনগুলো সময়ের সাথে সাথে প্রশ্নসাপেক্ষ হয়ে যায়।
প্রিয় বন্ধু কানাডার প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী Pierre Trudeauর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নেবার পর ২০১০ সালে এক সাক্ষাৎকারে আমন্ত্রণ জানানো হয় ফিদেল কাস্ত্রোকে টেলিভিশনে, অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাবেই সেইখানের প্রথম চারটি প্রশ্নোত্তর এখানে দিলাম-
১ম প্রশ্ন- মিঃ প্রেসিডেন্ট, আপনার কি মনে হয় না কিউবার অর্থনীতি অত্যন্ত খারাপ অবস্থার সম্মুখীন?
ফিদেল- অবশ্যই। আমি জানি আমরা অত্যন্ত খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে বিশ্বের সবচেয়ে সম্পদশালী ও শক্তিশালী রাষ্ট্রটি আমাদের সাথে সকল ধরনের বাণিজ্যের উপরে নিজেধাজ্ঞা আরোপ করেছে গত কয়েক দশক ধরে এবং আমাদের উৎপাদিত সমস্ত পণ্য বিশেষ করে চিনির সবচেয়ে বড় ক্রেতা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর টিকে নেই, কাজেই সঙ্গত কারণেই আমাদের অর্থনীতি সাময়িক ভাবে খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
২য় প্রশ্ন- কিউবায় অনেক রাজনৈতিক বন্দী, কেন ?
ফিদেল- ঠিক বলেছেন। দেখুন, বিশ্বের যে কোন দেশে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর কাজে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে সেই ব্যক্তি বিশেষের বিরুদ্ধে সবসময়ই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়, কোন দেশই এর ব্যতিক্রম নয়, যুক্তরাষ্ট্রতো নয়ই! কিউবাতেও এমন রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা ধরা পড়লে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু শতকরা একশ ভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি আপনি কিউবায় একজনও রাজনৈতিক বন্দী দেখাতে পারবেন না যা কে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, একজনও না ।
( আজ পর্যন্ত ফিদেলকে অন্তত ৬৩০ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে সি আই এর অর্থায়নে, যে টা কিউবার প্রেসের কথা না, সি আই এর সাবেল কর্মকর্তার কথা , এর বিরুদ্ধে কি কিউবার সরকার একবারও একটি বোমা হামলা চলিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, বা একটি সহিংস ব্যবস্থা !!)
৩য় প্রশ্ন- কিউবায় সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য?
ফিদেল- কথা হয়ত সত্যি। দেখুন, আমাদের একটি ক্ষুদে দ্বীপে ছোট একটা জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্রতর সংবাদ মাধ্যম রয়েছে, আমরা সেখানে যাচাই বাছাই করে সংবাদ দেবার চেষ্টা করি। আপনার খেয়াল রাখতে হবে কিউবান বিপ্লবের পরে দেশ ছাড়া বুর্জোয়া কিউবানরা ঘাঁটি গেড়েছে ফ্লোরিডায়, সেখানে থেকে মার্কিন অর্থায়নে চলছে তাদের একাধিক রেডিও চ্যানেল। মানব মন এক মিথ্যা অনেক বার শুনলে শেষ পর্যন্ত মিথ্যাতেই বিশ্বাস স্থাপন করে। তাই আমরা চেষ্টা করি আমাদের ক্ষুদ্র সংবাদ মাধ্যমটিকে রক্ষার।
এই পর্যায়ে ফিদেলের বাগ্মিতায় এবং বস্তুনিষ্ঠ সৎ উত্তরে বিব্রত হয়ে খেই হারিয়ে ফেলে একই প্রশ্ন করে বসেন প্রশ্নকর্তা-
৪র্থ প্রশ্ন- কিন্তু এটা কি সত্যি না যে কিউবার অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে?
ফিদেল– এই প্রশ্নটির উত্তর আগেই দিয়েছি, তারপরও বলছি- আপনি অর্থনীতি দুর্বল বলতে কি বোঝাতে চেয়েছেন? আমি অবশ্যই চাই, কিউবার প্রতিটি নাগরিক একটি গাড়ীর মালিক হোক, একটি প্রাসাদের মালিক হোক, অনেক বিত্ত বৈভব থাকুক। কিন্তু আমাদের সীমিত সম্পদে আমরা এটাও চেষ্টা করেছি যেন তারা জীবনের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনগুলো মিটলে যেন সুখী জীবনযাপন করে। আপনার বলা এই দুর্বল অর্থনীতি দিয়েই কিন্তু কিউবা আজ বিশ্বের অন্যতম সেরা চিকিৎসা ব্যবস্থা ও শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীদার এবং তা সকল নাগরিকের জন্য। আমাদের চেয়ে অনেক অনেক গুণ অর্থ সম্পদ থাকার পরও কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান বণ্টন ব্যবস্থা আমাদের মত উন্নত নয় এবং সকল নাগরিকের জন্য সুষম নয়। আর একটা কথা, আমার এত কাছের প্রতিবেশী, আমাদের সাথে ব্যবসা করতে যুক্তরাষ্ট্রের নিসেধাজ্ঞা কেন? তারা বলবে আমরা কমিউনিজম চর্চা করি, কিন্তু কম্যুনিস্ট অনেক দেশ যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনের সাথে তো তাদের রমরমা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, এবং অত্যন্ত দুঃখের কথা তাদের সাথে অনেক একনায়কচালিত দেশ, এমনকি ফ্যাসিস্টদের সাথেও জোরদার ব্যবসা ছিল। তাহলে, এই অন্যায়টা তারা আমাদের সাথে কয়েক দশক ধরে কেন করে আসছে!
( কিউবার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সহ সকল দেশ সমর্থন দিলেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসারেয়েলের বিরোধিতার কারণে আজও সেই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ। শুধু তাই নয়, কিউবানদের দেশ ত্যাগে উৎসাহিত করার জন্য ফ্লোরিডায় আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যে কোন কিউবান নাগরিক সৈকতে পৌঁছাতে পারলেই আমেরিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার দাবী রাখে। সেই সাথে সাধারণ এক মার্কিন নাগরিকের কিউবা ভ্রমণের অনুমতি নেই তাদেরই গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষ থেকে, যে কোন মার্কিন নাগরিক সরকারের বিশেষ অনুমতি ছাড়া কিউবা গেছে জানা গেলেই প্রায় পচিশ হাজার ডলারের জরিমানা তার জন্য অপেক্ষমাণ , কিন্তু কিউবা সবসময় স্বাগতম জানিয়ে এসেছে সকল দেশের নাগরিককেই !!)
আচ্ছা, এখন প্রশ্ন হচ্ছে ফিদেল কাস্ত্রো কি একনায়ক? বিশ্বের যে কোন দেশে একনায়কের কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য আছে, নিজের ছবি দেশের সবখানে টাঙ্গানো, সেই দেশের মুদ্রায় তার ছবি ছাপা, মোড়ে মোড়ে নিজের মূর্তি বানানো, নিজের নামে রাস্তা, ঘাট, সেতু, বিমানবন্দর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করা।
মুস্কিল হচ্ছে, কিউবায় ফিদেল বা কিউবার বিপ্লবের জীবিত কোন নায়কের নামের কিউবাতে কিছু নেই, কোন সেতু, স্কুল, ভাস্কর্য, রাস্তা! কিউবার স্কুলের শিশুরা প্রতি সকালে চে গুয়েভারার ছবি হাতে বলে- আমরা সবাই চে,র মত হব। সেই সাথে নিহত বিপ্লবী ক্যামিলোর স্মৃতি বিজড়িত অনেক কিছু আছে, কিন্তু নেই জীবিত কারো নামে।
বাইরের পৃথিবীর মানুষকে প্রায়শই ভুল বোঝানো হয় এই বলে কিউবা তো শাসন করছে কাস্ত্রো পরিবার, ফিদেল গেল তো ছোট ভাই রাউল এল ! কথাটি যারা কিউবার ইতিহাস নিয়ে সামান্যও জানেন তাদের জানার কথা কি রকম মিথ্যা! রাউল কাস্ত্রো ফিদেলের ছোট ভাই নয়, সেই বিপ্লবের সময় থেকেই জাতির নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন কাঁধে কাঁধে মিলিয়ে অন্যদের সাথে, এ পদ তার যোগ্যতারই পুরষ্কার। এখন যারা সর্ষের মাঝে ভুত খুজতে চান, তাদের প্রতি একটাই প্রশ্ন- বিশ্বের আর সবার মত নিশ্চয় ফিদেলও চান তার সন্তানকে তার উত্তরসুরী করতে। বলুন দেখি, তার কয় সন্তান! এবং তারা কি করে!, তার কোন ছেলে রাষ্ট্রীয় পদে আদৌ আছে কি না তারা একজন সাধারণ কিউবানের চেয়ে বেশী সুযোগ সুবিধা ভোগ করে কি না?
ফিরে আসার পর আমার অনেক ফিনিশ বন্ধু প্রশ্ন করেছে- কিউবানরা কি সুখী? এখন মানুষের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে দামি প্রশ্ন হল সুখ কি ! এর মানে কি আজ পর্যন্ত আমরা জানি! পাল্টা প্রশ্ন করি, আচ্ছা, ফিনল্যান্ড যে বিশ্বের সেরা দেশ হল, এখানকার মানুষ কি সুখী? যদি এতই সুখী হয়, তাহলে এত বেশী মানুষ আত্নহত্যা করে কেন! অর্থই যদি এত সুখ দেবে তাহলে ধনশালী দেশগুলোতে যেমন- জাপান, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মাঝে আত্নহননের হার এত বেশী কেন?
কিউবানদের সুখ নিয়ে আমাকে সবচেয়ে গোছানো উত্তর দিয়েছে বহু বছরের পুরনো বন্ধু ফ্রান্সের মেয়ে হেলেন লেতুফ-ব্রিনিঊ। সে শুধু সারা বিশ্ব ঘুরেই নি বরং অনেক দেশে বেশ কিছু মাস বা বছর বসবাস পর্যন্ত করেছে ( ভারত, মেক্সিকো, সুইডেন) , সেই সাথে তার স্প্যানিশটা মাতৃভাষার মত সড়গড় হওয়ায় সাধারণ মানুষদের সাথে মিশতে হয়েছে ঢের সুবিধা। তার মতে- কিউবানরা তার দেখা সবচেয়ে সুখী জাতি, তার অন্যতম প্রধান কারণ কিউবা সমাজ ব্যবস্থায় সকলের সমান অধিকার এবং এখনো খানিকতে পুরনো ধারার জীবন অনুসরণ করে চলায় সকলের হাতের রয়েছে অফুরন্ত সময় ফলে মানুষে মানুষে যোগাযোগের ব্যাপারটা রয়েছে এখনো অটুট।
হেলেনের কাছেই জানলাম কিউবায় তার অবস্থানকালীন সময়ে বিশ্বখ্যাত কিউবান চিত্রকর, লেখক, নর্তক, ক্রীড়াবিদের সমাজের আর দশ জন মানুষের মতই আড্ডা দিতে দেখেছে সে কফির দোকানে, বা মাছ ধরতে সাগরের পাশে, কোন সময় স্বেচ্ছা সেবামুলক পরিষ্কারের কাজে। এগিয়ে যেয়ে কথা বললেই তারা সময় দিয়েছে, তার মতে বিশ্বের আর কোন দেশে এটা সম্ভব না, ব্যাপারটা অনেকটা এমন- রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এমন সময় স্টিভেন স্পিলবার্গ বা মাইকেল জ্যাকসনের সাথে দেখা হয়ে গেল, তারা আমাদের সাথে কথাও বললেন আধা ঘণ্টা!
আর হ্যাঁ, কিউবানরা প্রবল বন্ধুত্বপরায়ণ। এই একটি ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। অচেনা লোক হয়ে রীতিমত ঘরের ভেতরে ঢুকে চা খাবার অভিজ্ঞতা হয়েছে এই অল্প সময়েই একাধিকবার।
আমি বিশ্বাস করি, যে কোন সমাজের বর্ণবাদীতা আছে কিনা তা বোঝার অন্যতম উপায় হচ্ছে শিশুদের সমাজের দিকে দৃকপাত করা। যদি সব শ্রেণীর, সব বর্ণের, সব ধর্মের শিশুদের একসাথে রাস্তায় দেখি বা পুকুরপাড়ে আড্ডা মারতে বোঝা যায় এই সমাজে বর্ণ বৈষম্য ও শ্রেণী বৈষম্যের রাক্ষুসে থাবা অনেক কম কার্যকরী
( বাঙ্গালী সমাজ যে অন্যতম বর্ণবাদী সমাজ তাও এখান থেকেই বোঝা যায়, বড়দের শিখিয়ে দেয়া পথ অনুসারেই আমরা বিকেলের মাঠে খেলতে যায় আমাদের মত পরিবারের বাচ্চাদের সাথেই, সহপাঠীদের সাথে, একজন শ্রমজীবী রিকশাওয়ালা বা মৎস্যজীবীর শিশু সেই জগতে ঢোকার অনুমতি পায় না, আর সমবয়সী কাজের মানুষের শিশুটি যে জন্মসূত্রেই দাস )।
কিউবায় অভিভূত হয়েছি এই দারুণ প্রায় অসম্ভব ব্যপারে, অনেক অনেক জায়গাতেই, ষ্টেশন থেকে শুরু করে নির্জন সৈকত, জনাকীর্ণ রাস্তা সবখানেই নানা বর্ণের, নানা জাতের বাচ্চারা উপস্থিত- সাদা, কালো, বাদামী, হলদে- কেউ বাদ নেই। কেমন করে সম্ভব হল এটা? উত্তর খুজতে যেয়ে পাওয়া গেল চমকপ্রদ কাহিনীর অস্তিত্ব!

কিউবার সরকারই ঠিক করে দেয় কোন পরিবার কোন এলাকায় থাকবে। তাই, অনেক দশক আগেই, বর্তমান সরকার এমনভাবে এলাকা ভিত্তিক বাসস্থান গড়ে তুলেছিল যাতে সব বর্ণের মানুষেরাই সেখানে ছন্দবদ্ধ ভাবে থাকে মিলে মিশে। তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মরা যখন একসাথে খেলতে শিখল, তারা দেখল তাদের সমাজে এইটাই একমাত্র সত্য, সব স্তরের, সব বর্ণের বাচ্চারা একসাথে খেলে, বড় হয়, স্কুলে যায়। বর্ণবাদ ছুতে পারে না তাদের। ইস, নয়নসার্থক হয়েছিল এই অপূর্ব দৃশ্যগুলোতে।

বিজ্ঞানের কিছু ধ্রুব তত্ত্ব বাদে সম্ভবত বিশ্বের কোন কিছুই চিরস্থায়ী না, মানুষের তৈরি সমাজ ব্যবস্থায় অসংখ্যবার ভাঙ্গা-গড়ার মাধ্যমে নতুন ব্যবস্থা এসেছে এবং আসবে। কোন সমাজ ব্যবস্থাই শতভাগ ত্রুটিমুক্ত এবং সার্থক নয়। রাউল কাস্ত্রো নিজেই কিছুদিন আগে বলেছেন, তাদের সরকার ভবিষ্যতে নেতা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নিঃসন্দেহে কিউবার সমাজ ব্যবস্থাতেও তলিয়ে দেখলে কিছু ফাঁকফোকর চোখে পড়বে, কিন্তু আমি দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে পারি, কিউবার প্রচলিত সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপালের তথাকথিত ঘেয়ো, পচা, অচল, অথর্ব গণতন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশী মানবতার অধিকার সংরক্ষণ করে। অনেক অনেক বেশী কার্যকরী জনগণের মৌলিক অধিকার পূরণ করতে।

সুত্রঃ http://www.sachalayatan.com/tareqanu/42588
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন