২৯ মার্চ, ২০১২

ফাতু-হিভা , আমার প্রিয় বই

ফাতু-হিভা, আমাদের গ্রহের স্বর্গ। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে, আর সব দেশ-মহাদেশের বাঁধন ছিন্ন করে অতল নীল মহাসাগরের বুকে ফুঁড়ে ওঠা চির সবুজে ছাওয়া পাথর-মাটি মেশানো কয়েকটি একরত্তি দ্বীপের সমাহার। পলিনেশিয়ায় অবস্থিত, তাহিতির খুব কাছের মারেক্কস দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত ত্রিভুবনের অমরাবতী।
নরওয়ের পাঁশুটে শহরজীবনের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে এক সোনালীচুলো যুবক ঠিক করল সারা জীবনের জন্য চলে যাবে এই শহর আর কৃত্রিম সভ্যতা ছেড়ে, ফিরে যাবে প্রকৃতির কোলে, যেখানে সময় অফুরন্ত, নেই অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের জন্য নগ্ন হাহাকারময় চাহিদা, জীবন যাপনের অত্যাবশ্যকীয় আহার, পানীয়ের নুন্যতম সংস্থান হলেই খুশী থাকে সবাই। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার বজ্রের দেবতা থরের নামে নাম এই যুবকের থর হেয়ারডাল। অনেক হিসাব নিকাশ কষে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে নিয়ে রওনা দিলেন এই স্বর্গ পানে, কোন দিন লোকসমাজে না ফেরার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। তাকে নিয়ে অবশ্য একটি লেখা লিখেছিলাম সচলে আগে।
সারা বিশ্ব পরবর্তীতে থর হেয়ারডালকে চিনেছে প্রাতঃস্মরণীয় অভিযাত্রী, নৃতত্ত্ববিদ, লেখক হিসেবে। কন-টিকি, রা, ইউফ্রেতিস প্রমুখ দুঃসাহসী অভিযানের দলনেতা হিসেবে। কোটি কোটি মানুষের ধারণা ভুল প্রমানিত করে স্রেফ বালসা কাঠের তৈরি ভেলায় আধুনিক সাজ-সরঞ্জাম ছাড়াই পাড়ি দিলেন প্রশান্ত মহাসাগরের বিপুল বিক্ষুদ্ধ জলরাশি, প্রমাণ করার চেষ্টা চালালেন আদি রেড ইন্ডিয়ানরা অনেক আগেই ল্যাতিন আমেরিকা থেকে একই ভাবে ভেলার মাধ্যমে যেয়ে বসতি গেড়েছিল পলিনেশিয়ায়। একই চেতনায় নলখাগড়া দিয়ে নৌকা বানিয়ে পাড়ি দিলেন আটলান্টিক মহাসাগর, দেখাতে চাইলেন প্রাচীন মিশরীয় ও মায়া সভ্যতার মধ্যকার মেলবন্ধন কিন্তু ফাতু-হিভা ছিল তার প্রথম যাত্রা- নিজের সন্ধানে, জ্ঞানের জিগীষায়, প্রকৃতির খোঁজে।
১৯৩৮ সালে নরওয়েজিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হয় ফাতু-হিভা, ২য় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে আন্তর্জাতিক মহলের চোখে পড়বার আগেই লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় এই মহান আলেখ্য, অনেক অনেক দশক পরে ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয় তা ইংরেজিতে। ব্যস, ভিনি, ভিডি, ভিসি- কোটি কোটি পাঠকের মনে চিরস্থায়ী আসন গেড়ে বসল তার সেই স্মৃতিচারণা।
থরের ঝুলিতে ছিল মুক্তোঝরা ভাষা, অভিজ্ঞ ডুবুরীর মত মনের শব্দ ভাণ্ডারের অতলে ডুব দিয়ে অনায়াসে নানা মূল্যবান শব্দ সম্ভার তুলে এনে শিল্পীর অপরিসীম দক্ষতায় ছুঁয়ে ছেনে পরিমাপমত একের পর এক স্বচ্ছ দ্যুতিশীল মায়াময় শব্দ বসিয়ে নির্মাণ করেছেন কল্পলোকের সাহিত্যদুর্গ। সেই অবারিত দ্বিধাহীন পথ বেয়ে আমিও চলে গিয়েছি অজস্রবার স্বপ্নের দ্বীপপুঞ্জে, যেখানে সবুজ নারকেল পাতার চিরল বাতাসে কেপে ওঠে ভোরের মৃদু আলো, দিগন্তে আকাশ আর সাগরের মিলনস্থানে কেবলই মন ভুলানো নীলের সহাবস্থান, দীঘল ঘাসের বনে সরসর করে ছুটে যায় মুক্ত হাওয়া, গতিতে তার বুনো ঘোড়ার উদ্যমের প্রাচুর্য, নিশিরাতে নিশাচর পাখির শব্দ ছাড়া সমস্ত বিশ্ব চরাচর নিস্তব্ধ, আকাশগঙ্গার অনন্ত নক্ষত্র বীথি নেমে আসে আমার মাথায় চাঁদোয়া খাটিয়ে দিতে প্রতিদিন সেই দূষণমুক্ত আকাশে।
তার শব্দ বিন্যাস আর রচনাগুণে নিশিগ্রস্ত মানুষের মত আমি ভিড়ে যাই থর আর তার স্ত্রী লিভের দলে, সমস্ত ধরনের কোলাহল থেকে যোজন যোজন দূরে এসে প্রথম সন্ধ্যায় তাবু খাটায় তারা, নক্ষত্রের আগুনে আলোকিত নিবিড় শান্তিময় মধ্যরাতে হঠাৎ কামানের গোলা পতনের শব্দে হতচকিত করে তোলে সবাইকে, সন্ধান করে পাওয়া যায় ঝড়ো বাতাসে উপর থেকে খসে পড়েছে ঝুনো নারকেল! নিরীহ দর্শন নারকেলগুচ্ছকে এমন মৃত্যুদূতের ভূমিকায় দেখে নিরাপদ স্থানে তাঁবু সরিয়ে ফেলে তারা, প্রথমবারের মত বিপদের সম্মুখীন হয়ে সেই পুরনো বাণী উদয় হয় তাদের চিন্তা মাঝে- স্বর্গেও সাপ আছে!!
আদিম জীবনে ফিরে যাবার প্রানান্তকর চেষ্টা চালায় তরুণ দম্পতি, লজ্জা নিবারণের যৎসামান্য আবরণ ধারণ করেই ক্ষুন্নিবৃত্তি মেটাবার তাগিদে ফল আহরণ ও মাছ শিকারে সচেষ্ট হয় তারা, রূপকথার আদম- ইভের মত। কিন্তু স্বর্গে একা নয় তারা, আছে স্থানীয় আদিবাসীরা, যারা দেখাতে লাগল মাত্রাতিরিক্ত উৎসাহ এই পাগলাটে শ্বেতকায়দের ব্যাপারে, নিরিবিলি স্বেচ্ছা নির্বাসনের মূল ধারণাই ভেস্তে যায় বুঝি!
ক্রান্তীয় জঙ্গলের গভীরে কুঁড়ে বানালেন বাঁশ কেটে, ঘর ছাইলেন পাতা দিয়ে, শুরু হল অন্য ধরনের সংসার জীবন। উৎপাত হিসেবে চলতে থাকল পাগল করা জীবাণু পরিবহনকারী মশার কামড়, প্রতিকূল আবহাওয়া, অন্যান্য রোগের সংক্রমণ। সেই সাথে স্থানীয়দের অসহযোগিতা।
অবশেষে কুঁড়ে ছেড়ে অন্য দ্বীপে যেয়ে তারা পাথরের গুহার আশ্রয় নেন। একইসাথে নানা দ্বীপের আদিবাসীদের সংশ্রবে এসে তাদের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণার আগ্রহ জন্ম নেয় থরের মনে, সেখানে প্রাপ্ত প্রাচীন মাথার খুলি ও লোকগাথায় ল্যাতিন আমেরিকার সাথে অদ্ভুত সাদৃশ্য খুঁজে পান তিনি, বিশাল সব নির্বাক প্রস্তর মূর্তি দেখে মাথার ভেতরে প্রশ্ন ফেনিয়ে ওঠে তাহলে কি প্রচলিতমতের পূর্ব এশিয়া নয়, দক্ষিণ আমেরিকাই এই দ্বীপবাসীদের আদি বাসস্থান।
সেখানে দেড় বছরের অবস্থানের এক ফাঁকে স্বপ্নদ্বীপ তাহিতি গিয়েছিলেন তিনি, মালিক বনেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে দামী রাইফেলের, কারণ সেই রাইফেলের কাঠের কুঁদোতে যে রঙচঙে ছবি আঁকা ছিল তা এঁকেছিলেন স্বয়ং পল গগ্যাঁ! ইম্প্রেশনিজমের দিকপাল এই ফরাসী চিত্রকর তার জীবনের সেরা কাজগুলো সবই করেছিলেন আলো ঝলমলে তাহিতিতে, তার সমাধিও এইখানে অবস্থিত। পরে এক বেরসিক কাস্টমস কর্মকর্তা নিরাপত্তার দোহাই দেখিয়ে রাইফেলের কুঁদোটি খুলে নেয়, লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় সেই বিশ্ব সম্পদ।
এমন ভাবে আরব্যপন্যাসের জাদুকরের মত বইয়ের খসখসে পাতায় নির্বাক পিঁপড়ার সারির মত কালো কালো অক্ষরগুলো থেকে লাল-নীল-সবুজ বর্ণময় ছন্দময় কাহিনীর জন্ম নেয় একের পর এক থরের বর্ণনার গুণে। আমাদের চারপাশের চেনা জগত একনিমিষে রঙধনুর সপ্তবর্ণা ত্রান্তীয় অঞ্চলে পরিণত হয়।
নরখাদকদের সাথেও পরিচয় ঘটে তাদের, বাস করতে হয় একই সবুজ উপত্যকায় প্রতিবেশী হিসেবে, গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তাদের জীবনধারা। পান ভবিষ্যৎ গবেষণার পর্যাপ্ত রসদ, যা তাকে ব্যস্ত রাখে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
বইটির শেষ পর্যায়ে এসে ফেলে আসা শহুরে জীবনের টানে উম্মুখ হয়ে পড়েন তরুণ দম্পতি, যতটা না সেই নিরাপদ জীবনের আরাম-আয়েশের জন্য, তার চেয়ে বেশী এখানকার নানা সমস্যার কারণে।
থর ফিরে আসেন নরওয়েতে, রেখে যান তার লিগ্যাসি। আর এক অমূল্য স্মৃতিকথা, যা আমার মত পাঠকদের দিবারাত্রি নিয়ে যায় দক্ষিণের সেই স্বর্গে। ফাতু-হিভার কাছে আমার অপরিসীম কৃতজ্ঞতা জীবনকে নতুন দৃষ্টিতে দেখার প্রেরণা দেবার জন্য, নতুন নতুন অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়বার জন্য, সর্বোপরি জীবনকে ও আমাদের সুন্দর গ্রহটাকে ভালবাসতে শেখাবার জন্য।
tumblr_lbxh93dR8n1qdyd55o1_500 


সুত্রঃhttp://www.sachalayatan.com/tareqanu/43215

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

bdnews24.com - Home

ইরান বাংলা নিউজ

বিবিসি বাংলা

দৈনিক সংগ্রাম