২৬ মে, ২০১২

যে ১১টি পাখির নামের সাথে বাংলাদেশ জড়িত


2 Indian Roller (Coracias bengalensis)
বহু গুণে গুণান্বিত বিশ্বখ্যাত সুইডিশ বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়ের (Carl Linnaeus) আবিস্কার করলেন সমস্ত প্রাণীর নামকরণের এক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যাতে প্রাণীটির পরিবার, প্রজাতি, গণ সম্পর্কে নামের মাধ্যমেই প্রাণীজগতে এর অবস্থান বোঝা যায়। ১৭০৭ সালে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি জীবনের একটি বড় সময় ব্যয় করেছিলেন সারা বিশ্ব থেকে তার কাছে পাঠানো জীবজগতের নমুনার নামকরণে, যাকে আমরা বৈজ্ঞানিক নামে বলে থাকি, যা হয়েছিল মূলত ল্যাটিন ভাষায়। সে গল্পের ব্যপ্তি এবং গুরুত্ব এতই বিশাল যে অন্যদিনের জন্য তোলা থাকল ।
সুইডিশ বিজ্ঞানীটি সারা বিশ্বে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের জানালেন নমুনা পাঠাবার সময় সাথে স্থানীয় নামটিও পাঠাবার জন্য। যখন বাংলা থেকে তার কাছে সাদা- কালোয় মেশানো অপূর্ব সুন্দর একটি পাখি পৌঁছাল ( যার ভোরের সূর্য উঠানো জাদুময় সুর মূর্ছনা শোনার সৌভাগ্য হল না তার) যার স্থানীয় নাম দোয়েল, তার উচ্চারণে হল ডয়েল, আনমনে ভাবছিলেন ডয়েল, ডায়াল, সান-ডায়াল, হ্যাঁ, পাওয়া গেছে নাম! সূর্যের নামে পাখিটির নাম হল Copsychus saularis । এমন সব চমৎকার ইতিহাস আছে প্রতিটি নামের সাথেই।
সারা বিশ্বের প্রায় ৯০০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১১টির বৈজ্ঞানিক নামের সাথে bengalensis বা বাংলার — পাখি শব্দটি জড়িত আছে। জড়িয়ে আছে বাংলার নাম, চলুন আর শুনি তাদের গল্প, দেখি তাদের মন ভরানো সৌন্দর্য, পরবর্তীতে তাদের দেখবেন বুনো মুক্ত পরিবেশে-
১) বাংলা শকুন, White-rumped Vulture, Gyps bengalensis
8 White-rumped Vulture  Gyps bengalensis
বর্ণনা- বাংলা শকুন বিশাল, প্রশস্ত ডানা এবং কালচে দেহের অধিকারী পাখি (দৈর্ঘ্য ৯০ সেমি, ওজন ৪.৩ কেজি, ডানা ৫৫ সেমি, ঠোঁট ৭.৬ সেমি, পা ১১.৬ সেমি, লেজ ২২.৫ সেমি)। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির মলিন গলাবন্ধ সাদা এবং দেহ কালচে-বাদামী, কোমর স্পষ্ট সাদা, পালকহীন মাথা ও ঘাড় কালচে ধূসর।
মাথার ওপর দিয়ে ওড়ার সময় সাদা গলাবন্ধ, কালচে দেহ এবং ডানার নিচের দিকের সাদা পালক- ঢাকনি ও ওড়ার-পালকের কালচে পাড়ের পার্থক্য দেখে চেনা যেতে পারে। চোখ হলদে-বাদামী কিংবা ফিকে বাদামী, কালচে হালকা খয়েরি অথবা সবুজ-হালকা খয়েরি, ঠোঁটের ঝিল্লি কালো, মাথা ও ঘাড়ের পালকহীন চামড়া কালচে হালকা খয়েরি, এবং পা ও পায়ের পাতা কালো। ছেলে ও মেয়ের চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির কালচে বাদামি দেহ ও ডানার উপরে সূক্ষ সাদা ডোরা রয়েছে। কোমর কালচে ও ডানার পালকের নিচের ঢাকনিতে সরু সাদা টান রয়েছে।
স্বভাব- বাংলা শকুন বনের ধার, গ্রাম, ভাগাড় ও কসাইখানায় বিচরণ করে এবং এরা সবসময় দলবদ্ধ ভাবে থাকে। আহারের খোঁজে এরা আকাশে টহল দেয় অথবা উঁচু গাছ বা দালানে বসে থাকে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে মৃত প্রাণী এবং পচা মাংস। খাবার দেখতে পেলে শো শো শব্দে দ্রুত নিচে নেমে আসে, এবং খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে ও কর্কশ গলার ঘড়ঘড়, হিসহিস কিংবা একটানা চিঁচিঁ চিৎকার করে।
সেপ্টেম্বর-মার্চ মাসে প্রজননকালে উঁচু গাছ বা দালানের ভগ্নাবশেষে ডালপালা দিয়ে মাচার মত বাসা বানায় এবং বছরের পর বছর একই বাসা ব্যবহার করে। এ বাসায় মেয়েপাখি একটি সাদা ডিম পাড়ে, ডিমের মাপ ৮.৬ x ৬.৪, ডিম ফুটতে ৪৫ দিন লাগে।
বিস্তৃতি- বাংলা শকুন বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি, সব বিভাগেই দেখা যায়। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চীন, ইরান, আফগানিস্তান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসহ এশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা শকুন বিশ্বের মহাবিপন্ন বলে পরিচিত। গবাদিপশুর চিকিৎসায় ডাইক্লোফেনিক ব্যবহারের ফলে বিগত শতকের সুলভ এই পাখির সংখ্যা ৯৮ % হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশে এ প্রজাতিটি এখনও বিপদগ্রস্ত পাখির তালিকাভুক্ত করা হয় নি। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা শকুনের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার শকুন! ( Gyps = শকুন, bengalensis= বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি ইনাম আল হকের তোলা।
২) বাংলা নীলকান্ত, Indian Roller , Coracias bengalensis
2 Indian Roller (Coracias bengalensis)
বর্ণনা- বাংলা নীলকান্ত বাদামি বুক ও নীল ডানার পাখি ( দৈর্ঘ্য ৩১ সেমি, ওজন ১৬৫ গ্রাম, ডানা ১৯ সেমি, ঠোঁট ৩.৫ সেমি, পা ২.৭ সেমি, লেজ ১৩ সেমি)। বসে থাকা অবস্থায় এর পিঠ লালচে বাদামি, উড়ে গেলে ডানার নীল রঙ দেখা যায়, ডানায় পর্যায়ক্রমে ফিকে নীল ও কালচে নীল পালক রয়েছে। গলাবন্ধ, ঘাড়ের পিছনের ভাগ, গলা ও বুক লালচে-বাদামি। কাঁধ-ঢাকনি ও ডানার গোঁড়ার পালক বাদামি জলপাই-সবুজ, তলপেট ও অবসারণী ফিকে নীল এবং লেজ গাঢ় নীল। এর চোখ বাদামি, ঠোঁট বাদামি-কালো, পা এবং পায়ের সঙ্গে সংযুক্ত অঙ্গ হলদে-বাদামি। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি অনুজ্জ্বল, কাঁধ-ঢাকনি মেটে বাদামি এবং গলা ও বুকে ডোরা রয়েছে। ৩টি উপপ্রজাতির মধ্যে C.b.bengalensis এবং সম্ভবত C.b.affinis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বাংলা নীলকান্ত পাতাঝরা বন, বনের প্রান্তদেশ, তৃণভূমি, ক্ষুদ্র ঝোপ, খামার ও গ্রামাঞ্চলে বিচরণ করে। পাতাহীন ডাল, বেড়ার বাঁশ অথবা বৈদ্যুতিক তারে একাকী বসে থাকে। নীরবে বসে এরা ধীরে লেজ ওপর-নিচে দোলায় ও নিচের ভূমিতে শিকার খোঁজে।
আহার্যতালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, টিকটিকি, ব্যাঙ ও সাপ। ঘাসে বা ঝোপে আগুন দেওয়া হলে পোকা ধরার জন্য এরা পাশে বসে অপেক্ষা করে।
এপ্রিল-মে মাসের প্রজনন ঋতুতে এরা উঁচু গলায় ও তীক্ষ সুরে ডাকে- ক্রাক, ক্রাক, ছেলে ও মেয়ে সমবেত ওড়ার মহড়া দেয় এবং গাছের কোটরে অথবা দালানকোঠার ফাঁকফোঁকরে ঘাস এবং খড়কুটো দিয়ে বাসা বেঁধে ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা ৩-৫টি, মাপ ৩.৮ x ২.৮ সেমি। ১৭-১৯ দিনে ডিম ফোটে, ২০-২৫ দিনে ছানার শরীরে ওড়ার পালক গজায়,
বিস্তৃতি- বাংলা নীলকান্ত বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি, সকল বিভাগের গ্রামাঞ্চলে বিচরণ করে। পারস্য উপসাগর থেকে পুরো ভারত উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সুদুর চীন ও মালয়েশিয়া পর্যন্ত এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা নীলকান্ত বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা নীলকান্তের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার তাউরা ( গ্রীক, Korakias= তাউরা, bengalensis=বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্রটি ইনাম আল হকের তোলা।
৩) বাংলা কাঠঠোকরা,Lesser Goldenback, Dinopium benghalense
1 Lesser Goldenback (Dinopium benghalense) Male
বর্ণনা- বাংলা কাঠঠোকরা বাংলাদেশের অতি চেনা কাঠঠোকরা ( দৈর্ঘ্য ২৯ সেমি, ওজন ১০০ গ্রাম, ডানা ১৪.২ সেমি, ঠোঁট ৩.৭ সেমি, পা ২.৫ সেমি, লেজ ৯ সেমি)। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ সোনালী-হলুদ, দেহতলে কালো আইশের দাগ, ওড়ার পালক ও লেজ কালো, থুতনিতে কালো ডোরা, সাদা ঘাড়ের পাশে কালো দাগ, বুকে মোটা কালো আইশের দাগ, চোখে কালো ডোরা, ডানার গোঁড়ার ও মধ্য-পালক ঢাকনিতে সাদা বা ফিকে ফুটকি এবং পিঠ ও ডানার অবশেষ সোনালি। সবুজ গোলকসহ এর ঠোঁট লালচে-বাদামি, পা ও পায়ের পাতা ধূসর সবুজ এবং ঠোঁট শিঙ-রঙ এবং কালোর মিশ্রণ। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারায় পার্থক্য তাদের চাঁদি এবং ঝুটির রঙে, ছেলেপাখির চাঁদি ও ঝুটি উজ্জল লাল এবং মেয়েপাখির সাদা বিন্দুসহ চাঁদির সামনের অংশ কালো ও পিছনের ঝুটি লাল। তরুণ পাখির অনুজ্জল দেহ ও চাঁদির সামনের ভাগের সাদা বিন্দু ছাড়া দেখতে মেয়েপাখির মত। ৪টি উপপ্রজাতির মধ্যে D.b.bengalensis বাংলাদেশে আছে।
1 Lesser Goldenback (Dinopium benghalense) Female
স্বভাব- বাংলা কাঠঠোকরা বন, বাগান ও লোকালয়ে সর্বত্র বিচরণ করে, একাকী, জোড়ায় বা পারিবারিক দলে দেখা যায়। গাছের কাণ্ড ও ডালে হাতুড়ির মত আঘাত করে অথবা মাটিতে ঝরাপাতা উল্টে এরা খাবার সংগ্রহ করে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঁপড়া, শুঁয়োপোকা, বিছা, মাকড়শা, অন্যান্য পোকামাকড় এবং ফুল ও ফলের রস।
শক্ত পা ও অনমনীয় লেজে ভর দিয়ে ছোট ছোট লাফ মেরে এরা গাছের কাণ্ড বেয়ে উপরে ওঠে, ওড়ার সময় উচ্চ স্বরে ডাকে- কিয়ি কিয়ি কিয়ি-কিয়ি-কিয়িকিয়িইরররর-র-র-র। ফেব্রুয়ারি- জুলাই মাসে প্রজনন ঋতুতে গাছের কাণ্ডে গর্ত খুঁড়ে বাসা বেঁধে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ৩টি, মাপ ২.৮ x ২.০ সেমি। ছেলে ও মেয়েপাখির উভয়ই বাসার সব কাজ করে। বাসায় হামলা হলে ছানারা সাপের মত হিসহিস শব্দ করে।
বিস্তৃতি- বাংলা কাঠঠোকরা বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি, সব বিভাগের সব বনে ও লোকালয়ে রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা কাঠঠোকরা বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা কাঠঠোকরার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার বলীয়ান ( গ্রিক deinos= শক্তিমান, opos=চেহারা, bengalensis=বাংলার)। পাখিটি বাংলাদেশে শুধু কাঠঠোকরা নামে পরিচিত।
ব্যবহৃত আলোকচিত্র ২টি ইনাম আল হকের তোলা।
৪ ) বাংলা কুবো, Lesser Coucal, Centropus bengalensis
3 Lesser Coucal  (Centropus bengalensis)
বর্ণনা- বাংলা কুবো পর্যায়ক্রমে পালকসজ্জিত লম্বা লেজওয়ালা কাকের মত পাখি ( দৈর্ঘ্য ৩৩ সেমি, ওজন ১২০ গ্রাম, ডানা ১৫ সেমি, ঠোঁট ২.৭ সেমি, পা ৩.৭ সেমি, লেজ ১৮ সেমি)। প্রজনন ঋতুতে পিঠ তামাটে ও দেহতল কালো হয়। অনুজ্জল তামাটে কাঁধ-ঢাকনি ও ডানা ছাড়া পুরো দেহই চকচকে কালো। প্রাথমিক ও তৃতীয় সারির পালকের আগা বাদামি এবং লেজ কালো। প্রজননকাল ছাড়া পাখির কালচে বাদামি মাথা ও কাঁধ-ঢাকনিতে পীতাভ শরের ডোরা এবং কোমরে কালচে বাদামি ও লালচে ডোরা রয়েছে। দেহতল পীতাভ এবং গলা ও বুকে ফিকে ডোরা আছে, সব ঋতুতেই চোখ গাঢ় লাল, ঠোঁট কালো এবং পা, পায়ের পাতা ও নখর স্লেট-কালো। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারায় কোন পার্থক্য নেই। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ডানা, মাথার চাঁদি, কাঁধ-ঢাকনি ও পিঠে কালচে বাদামি ডোরা থাকে। ৫ টি উপপ্রজাতির মধ্যে C.b.bengalensis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বাংলা কুবো উঁচু ঘাসের জমি, নল বন, ঘন গুল্ম, ঝোপ ও চা বাগানে বিচরণ করে। সচরাচর একা বা জোড়ায় থাকে। মাটিতে চুপিসারে হেঁটে এবং হঠাৎ শিকারকে ঠোঁট ও পা দিয়ে চেপে ধরে শিকার করে। খাবার তালিকায় ফড়িং ও অন্যান্য বড় পোকা রয়েছে। ওড়ার চেয়ে দৌড়াতে পছন্দ করে। ভোরে ও গোধূলিতে বেশ কর্ম তৎপর থাকে। দুটি অনুক্রমিক স্বরে ডাকে- কুপ-কুপ-কুপ কুরুক-কুবুক-কুরুক। মার্চ-অক্টোবর মাসে প্রজননকালে পূর্বরাগে ছেলে পাখি লেজ খাড়া করে ও বাকায়। ভূমির কাছাকাছি ঘন ঝোপে পল্লব, পত্র ফলক ও ঘাসের ডগা দিয়ে পার্শ্ব প্রবেশ পথসহ ডিম্বাকার বাসা বানায়। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ২-৪টি, মাপ ২.৮ x ২.৩ সেমি।
3 Lesser Coucal  (Centropus bengalensis) Juvenile
বিস্তৃতি- বাংলা কুবো বাংলাদেশের সুলভ আবাসিক পাখি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের ঝোপঝাড়ে ও চা বাগানে পাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীনের দক্ষিনাঞ্চল ও ফিলিপাইনে এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ ব্যতীত সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায় পাওয়া যায়।
অবস্থা- বাংলা কুবো বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে পরিচিত। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে এ প্রজাতিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয় নি।
বিবিধ- বাংলা কুবোর বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার গজাল-পা ( গ্রিক-kentron= গজালের মত নখর, pous= পা,bengalensis= বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্র ২টি ইনাম আল হকের তোলা।
৫) বাংলা ডাহর, Bengal Florican, Houbaropsis bengalensis
Douglas_Hamilton,_The_Bengal_Florican...36
বর্ণনা- বাংলা ডাহর বাংলাদেশে থেকে হারিয়ে যাওয়া বড় আকারের ভূচর পাখি, ( দৈর্ঘ্য ৬৬ সেমি, ওজন ২ কেজি, ডানা ৩৫.৫ সেমি, ঠোঁট- ৩.৭ সেমি, পা ১৭.৫ সেমি)। ছেলে ও মেয়ে পাখির চেহারায় পার্থক্য আছে, ছেলের মাথা ও ঘাড় মখমল কালো এবং সাদা ডানার আগা কালো, পিঠের বাকী অংশ কালো ও মেটে থেকে দারুচিনি পীতাভে মিশ্রিত, বুকে এক গুচ্ছ লম্বা পালক, দেহের নিচের দিকে মখমল বাদামি। মেয়েপাখি ছেলে পাখি থেকে আকারে কিছুটা বড়। পীতাভ ভ্রু-রেখা সমেত মাথার চাঁদি ঘন বাদামি ও পিঠে স্পষ্ট বাদামি রঙে কালো তীর-ফলকের দাগ, ঘাড়ের পাশে ঘন বাদামি সরু ডোরা ও দেহের নিচের দিক পীতাভ-সাদা, ডানার পালক ঢাকনি পীতাভ-সাদা ও ওড়ার পালকে বাদামি ডোরা। ছেলে ও মেয়ে পাখি উভয়েরই চোখ হলুদ, ঠোঁট ঘন বাদামি এবং পা ও পায়ের পাতা হলুদ। ২টি উপপ্রজাতির মধ্যে H.b.bengalensis এককালে বাংলাদেশে ছিল।
স্বভাব- বাংলা ডাহর বাদাবন, বন সংলগ্ন ঝোপের প্রান্তর ও বৃহৎ তৃণভূমিতে বিচরণ করে, ৪-৮টি পাখির ছোট দলে দেখা যায়। ঘাসে ও শস্যক্ষেতে ধীরে হেঁটে এবং ঠুকরে খাবার খায়, খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকামাকড়, টিকটিকি, ছোট সাপ, রসালো ফল, বীজ এবং ঘাসের ও শস্যের কচি ডগা।
ভোর ও গোধূলিতে এরা বেশী কর্মচঞ্চল থাকে এবং দলের সদস্যদের সাথে যোগাযোগের জন্য ধাতব স্বরে ডাকে- চিক-চিক-চিক। মার্চ- জুন মাসে প্রজনন কালে ছেলেরা লাফ দিয়ে উঁচু ঘাসের উপর ডানা ছড়িয়ে নিজেদের প্রদর্শন করে এবং তৃণভূমির মাটি সামান্য খুঁড়ে ঘাস বিছিয়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিমগুলো জলপাই-সবুজ, বেগুনি ফুসকুড়ি ও ফিকে বেগুনি-ধূসর দাগ আছে, সংখ্যায় ২টি, ৬.৪ x ৪.৬ সেমি। ৩০ দিনে ডিম ফোটে।
বিস্তৃতি- বাংলা ডাহর বাংলাদেশের প্রাক্তন আবাসিক পাখি, ঢাকা বিভাগের তৃণভূমিতে পাওয়া যেত, পাখিটি এখন আর নেই। বর্তমানে নেপাল, উত্তর-পূর্ব ভারত, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম পর্যন্ত এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা ডাহর বিশ্বে বিপন্ন ও বাংলাদেশে অপ্রতুল তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা ডাহরের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার ডাহর ( আরবি hubura= ডাহর, opsis= চেহারা, bengalensis= বাংলার)।
ব্যবহৃত চিত্রকর্ম নেট হতে সংগৃহীত।
৬) বাংলা রাঙাচ্যাগা, Greater Painted Snipe, Rostratula bengalensis
বর্ণনা- বাংলা রাঙাচ্যাগা ছেলেমেয়ের প্রচলিত ভূমিকা উল্টে নেয়া অনন্য জলচর পাখি, ( দৈর্ঘ্য ২৫ সেমি, ওজন ১২৫ গ্রাম, ডানা ১২.৫ সেমি, ঠোঁট ৪.৪ সেমি, পা ৪.৩ সেমি, লেজ ৪ সেমি)। ছেলের চেয়ে মেয়ে পাখি বেশী রঙ্গিন। অথচ পাখি জগতে এর উল্টোটিই হয় সবসময়, দেখুন পুরুষ পাখির ছবি-
6 Greater Painted Snipe  (Rostratula bengalensis) Male
এবং তার সঙ্গিনীর ছবি-
6 Greater Painted Snipe  (Rostratula bengalensis) Female
প্রজননকালে মেয়েপাখির পিঠের দিক কালচে ধাতব জলপাই-সবুজ অথবা ব্রোঞ্জ সবুজ, দেহের নিচের দিক সাদা, সাদাটে চোখের বলয়, চোখের পেছনে সাদা দাগ, মাথার চাঁদির ডোরা হালকা পীত বর্ণের। গাল, গলা, ঘাড়র পাশে ও বুক তামাটে কিংবা মেরুন, বুকের নিচের ফিতা কালো এবং দেহতলের শেষাংশ সাদা এবং ওড়ার সময় কালচে পিঠে স্পষ্ট সাদা V চিহ্নিত দাগ দেখা যায়। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেপাখির বর্ণবিন্যাস একই ধরনের কিন্তু অনুজ্জল এবং ডানার পালক-ঢাকনিতে এক জোড়া বড় সোনালি-পীতাভ তিলা আছে। ছেলে ও মেয়ে পাখি উভয়ের চোখ বাদামি, লম্বা কমলা-বাদামি ঠোঁট নিচের দিকে সামান্য বাঁকানো, পা জলপাই-সবুজ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির ডানার পালক-ঢাকনি ধূসর ও পিঠের মোটা তিলা ফিকে পীতাভ। ২টি উপপ্রজাতির মধ্যে R.b.bengalensis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বাংলা রাঙাচ্যাগা জলাভূমি, স্যাঁতস্যাঁতে তৃণভূমি ও প্লাবিত ধানক্ষেতে বিচরণ করে, সচরাচর এক, জোড়ায় কিংবা বিচ্ছিন্ন ঝাঁকে থাকে। অগভীর পানিতে হেঁটে ও মাটিতে ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খায়, খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকা, শামুক, চিংড়ি জাতীয় প্রাণী, কেঁচো, বীজ ও শস্যদানা।
ভোর ও গোধূলিতে এরা বেশী কর্মচঞ্চল হয়, ওড়ার সময় ফাঁপা গলায় পুনঃ পুনঃ ডাকে – পৌ—পৌ। জুলাই- সেপ্টেম্বর মাসে প্রজননকালে মেয়েপাখি গোধূলিতে গান গাওয়া শুরু করে এবং পূর্ণিমাতে পুরো রাত গম্ভীর গলায় পুনঃ পুনঃ গায় উওক—উওক। ( পাখি জগতে সাধারণত ছেলেরাই গান গায়, এটি বিরল ব্যতিক্রম)
ঘাসের গোঁড়ায় ঘাস বিছিয়ে বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো হলদে, সংখ্যায় ২-৫ টি, মাপ ৩.৬ x ২.৫ সেমি। ছেলেপাখি একাই ডিমে তা দেওয়া ও ছানাপালার কাজ করে, ১৫-২১ দিনে ডিম ফোটে। মেয়েপাখি অন্য ছেলের সাথে মিলিত হইয়ে অন্য বাসায় আবার ডিম পাড়ে।
বিস্তৃতি- বাংলা রাঙাচ্যাগা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগের জলাভূমিতে পাওয়া যায়। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত উপমহাদেশসহ এশিয়ায় এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি, তবে ভুটান ও মালদ্বীপে নেই।
অবস্থা- বাংলা রাঙাচ্যাগা বিশ্বে ও বাংলাদেশে বিপদমুক্ত বলে বিবেচিত। বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা রাঙাচ্যাগার বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার বড়ঠুঁটো ( ল্যাতিন rostratus=বড় ঠোঁটের, bengalensis= বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্র ২টি ইনাম আল হকের তোলা।
৭) বাংলা টিকিপানচিল, Lesser Crested Tern, Sterna bengalensis
7 Lesser Crested Tern  (Sterna bengalensis)
বর্ণনা- বাংলা টিকিপানচিল কালো ঝুটি ও ধূসর ডানার সামুদ্রিক পাখি ( দৈর্ঘ্য ৪৩ সেমি, ডানা ২৮.৫ সেমি, ঠোঁট ৫.৩ সেমি, পা ২.৮ সেমি, লেজ ১৩.৫ সেমি)। প্রজনন ঋতুতে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক ফিকে ধূসর, দেহের নিচের দিক একদম সাদা, কপাল, মাথার চাঁদি ও ঝুটি কালো, কোমর ডানা উপরি-ঢাকনি ও লেজের মাঝখানের পালক ধূসর এবং ডানার ওড়ার প্রথম পালক কালচে, ঠোঁট কমলা থেকে কমলা-হলুদ ও চোখ বাদামি, পা ও পায়ের পাতা কালো এবং পায়ের তলা হলদে থাকে। প্রজননকাল ছাড়া এর কপাল সাদা ও ঠোঁট ফিকে হলদে-কমলা হয়। ছেলে ও মেয়েপাখির চেহারা অভিন্ন। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠের দিক কিছুটা বাদামি-ধূসর, দেহের নিচের দিক সাদাটে, ডানার প্রান্ত-পালক কালচে, ডানায় কালচে ডোরা, কাঁধ-ঢাকনি, ডানা-ঢাকনি ও গোড়ার পালকে তিলা রয়েছে। ৩ টি উপপ্রজাতির মধ্যে S.b.bengalensis বাংলাদেশে রয়েছে।
স্বভাব- বাংলা টিকিপানচিল সাগর তীর, পোতাশ্রয়, জোয়ারীয় খাঁড়ি ও লবণ চাষের জমিতে বিচরণ করে,দলবদ্ধ পাখি ও সচরাচর বিচ্ছিন্ন দলে থাকে, প্রায়ই বাতাসি পানচিলের সাথে দেখা যায়। জলের সামান্য উপরে উড়ে ছোঁ মেরে এদের খাদ্য সংগ্রহ করতে দেখা যায়, খাদ্যতালিকায় প্রধানত রয়েছে মাছ ও চিংড়ি। দৃঢ় ভাবে ডানা নেড়ে উড়ে চলে এবং মাছারাঙ্গার মতই শূন্যে মুহূর্তের জন্য স্থির ভেসে থাকতে পারে, প্রায়ই গভীর সাগরে উড়ে যায়, জলে ঝাপ দেবার আগে সচরাচর ডাকে- ক্রীক- ক্রীক এবং ভয় পেলে উচ্চ শব্দে কিচমিচ করে ডাকে।
7 Lesser Crested Tern  (Sterna bengalensis) flock
মালদ্বীপ ও পারস্য উপসাগরের চরে মে-জুন মাসে প্রজননকালে ছেলেপাখি মেয়েকে মাছ এনে উপহার দেয় এবং মাটিতে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম সংখ্যায় ১-২ টি।
বিস্তৃতি- বাংলা টিকিপানচিল বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি। চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলে পাওয়া যায়। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত উপমহাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এরা বিস্তৃত তবে নেপাল ও ভুটানে পাওয়া যায় না।
অবস্থা- বাংলা টিকিপানচিল বিশ্বে বিপদমুক্ত এবং বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা টিকিপানচিলের বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ কমলা রঙের পানচিল ( পুরনো ইংরেজি starn= কমলা, bengalensis= বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্র ২টি ইনাম আল হকের তোলা।
৮ ) বাংলা বাবুই ,Black-breasted Weaver, Ploceus benghalensis
black_breasted_weaver4
বর্ণনা – বাংলা বাবুই কালো বুক ও মোটা ঠোঁটের ছোট বুননবিদ পাখি ( দৈর্ঘ্য ১১ সেমি, ওজন ২০ গ্রাম, ডানা ৭ সেমি, ঠোঁট ১.৬ সেমি, পা ২ সেমি, লেজ ৪ সেমি)। প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে ও ছেলে পাখির চেহারা ভিন্ন। প্রজননকালে ছেলেপাখির মাথার চাঁদি হলুদ, কালচে লম্বালম্বি দাগসহ পিঠের শেষাংশ কালচে বাদামি, কান-ঢাকনি ও গলা সামান্য বাদামি কিংবা সাদা, বুক বরাবর প্রশস্ত কালো ফিতা এবং পেট সাদাটে হয়। প্রজননকাল ছাড়া ছেলে ও মেয়েপাখির পেট পীতাভ, দেহের উপরিভাগের পিছনের অংশ লম্বালম্বি গালকা হলুদ দাগসহ কালচে বাদামি, ভ্রু-রেখা হলুদ, ঘাড়ের পিছনে কালচে রেখা ও ছোট্ট হলুদ পট্টি রয়েছে, কান-ঢাকনি বাদামি, হলুদ গলা ও উপ-গুম্ফ এলাকা কালচে, এবং বুকের কালচে-বাদামি ফিতা অসম্পূর্ণ থাকতে পারে। ছেলে ও মেয়ে উভয়ের চোখ হালকা বাদামি, ঠোঁট ফিকে খয়েরি এবং পা ও পায়ের পাতা হলদে মেটে। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি চেহারা মেয়েপাখির মত তবে বুক অপেক্ষাকৃত ফিকে।
স্বভাব- বাংলা বাবুই নল, মৌসুমে প্লাবিত উঁচু ঘাস ও আবাদি জমিতে বিচরণ করে, এরা দলবদ্ধ পাখি এবং সচরাচর ঝাকে থাকে। তৃণভূমি, শস্য-ক্ষেত ও প্রান্তরে এরা খাবার খোঁজে, খাদ্যতালিকায় রয়েছে বীজ ও পোকামাকড়।
সচরাচর এরা মৃদু স্বরে পুনঃপুনঃ ডাকে চিট চিট এবং গলা ছেড়ে কোমল কণ্ঠে গায় – সি সি সিসিক সিসিক সিক সিক। ছেলেপাখি গান গায়, মাথা নত করে এবং এর হলুদ ঠোঁট এবং চাঁদি দেখায়। জুন সেপ্টেম্বর মাসে প্রজনন মৌসুমে পানির ধারে উঁচু ঘাস কিংবা নলে পাতা ও ঘাসের সূক্ষ লম্বা ফালি দিয়ে ঝোলানো বাসা বুনিয়ে এরা ২-৪টি ডিম পাড়ে।
বিস্তৃতি- বাংলা বাবুই বাংলাদেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের হাওর এবং বড় পাড়ে পাওয়া যায়। বিশ শতকের মাঝামাঝি কাল পর্যন্ত খুলনা বিভাগে ছিল এমন তথ্য রয়েছে। ভারত, পাকিস্তান ও নেপালসহ দক্ষিণ এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা – বাংলা বাবুই বিশ্বে বিপদমুক্ত এবং বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা বাবুইএর বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার বাবুই (গ্রিক plokeus=বাবুই, benghalensis=বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্র নেট হতে সংগৃহীত।
৯) বাংলা ঘাসপাখি, Rufous-rumped Grassbird , Graminicola bengalensis
rufousrumpedgrassbird131aug08
বর্ণনা- বাংলা ঘাসপাখি একটি ডোরাযুক্ত লালচে-বাদামি পোকা-শিকারি পাখি ( দৈর্ঘ্য ১৬ সেমি, ডানা ৬ সেমি, ঠোঁট ১.৪ সেমি, পা ২.৪ সেমি, লেজ ১৪.৭ সেমি)। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির লালচে-বাদামি পিঠে মোটা কালো লম্বা দাগ থাকে, তবে কোমর ও ডানায় রয়েছে লালচে রঙের দাগ। এর ঘাড়ের পিছনের লম্বা সাদা দাগ কিংবা পীত বর্ণের, ভ্রু-রেখা সাদা, দেহতলের অধিকাংশ সাদা কিন্তু বগল ও বুকের পাশ লালচে-পীত বর্ণের, ঘোর কালচে-বাদামি প্রশস্ত লেজের আগা সাদা, এর অনেকাংশ নিচে থেকে দেখা যায়, চোখ লালচে-বাদামি, পা ও পায়ের পাতা মেটে-বাদামি এবং ঠোঁট বাদামি। ৩ টি উপপ্রজাতির মধ্যে G.b.bengalensis বাংলাদেশে পাওয়া যায়।
স্বভাব- বাংলা ঘাসপাখি সাধারণত পানির ধারের নল ও উঁচু ঘাসে বিচরণ করে, খুব নিভৃতচারী ও দিবাচর পাখি। প্রজনন মৌসুম ছাড়া সচরাচর ঘন ঘাসে লুকিয়ে থাকে। ভুম, নলের ঝোপ ও ঘাসে খাবার খোঁজে।
খাদ্যতালিকায় রয়েছে পোকামাকড়। বিরক্ত হলে অনিচ্ছায় ঘাসের আড়াল ছেড়ে সামান্য উড়ে ঘাসে লুকিয়ে থাকে। প্রজনন মৌসুম ছাড়া ডাকে- এর- উয়িট-উয়িট-উয়িট। জুলাই-আগস্ট মাসে প্রজননকালে ছেলেপাখি নলের চূড়া থেকে শ্রুতিকটু গান গায় এবং নলের উপর দিয়ে ওড়ার সময় একটু করে গান ধরে।
গভীর জলে দণ্ডায়মান ঘন ঘাসে নলখাগড়া এবং উদ্ভিদের আঁশের উপর সূক্ষ ঘাসের শিকড় বিছিয়ে গভীর বাটির মত বাসা বানিয়ে এরা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা, সংখ্যায় ৪টি, মাপ ১.৭ x ১.৪ সেমি।
বিস্তৃতি- বাংলা ঘাসপাখি বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি, প্রধানত সিলেট বিভাগের হাওরের চারপাশের নলে পাওয়া যায় এবং উনিশ শতকে ঢাকা বিভাগে ছিল এমন তথ্য আছে। ভারত, নেপাল, দক্ষিণ-পূর্ব চীন, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বৈশ্বিক বিস্তৃতি রয়েছে।
অবস্থা- বাংলা ঘাসপাখি বিশ্বের প্রায় বিপদগ্রস্ত এবং বাংলাদেশে অপ্রতুল-তথ্য শ্রেণীতে রয়েছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এ প্রজাতি সংরক্ষিত।
বিবিধ- বাংলা ঘাসপাখির বৈজ্ঞানিক নামের অর্থ বাংলার ঘাসপাখি( ল্যাতিন graminis =ঘাস, bengalensis= বাংলার)
ব্যবহৃত আলোকচিত্র নেট হতে সংগৃহীত।
১০) বাংলা হুতোমপ্যাঁচা, Indian Eagle-Owl, Bubo bengalensis
543px-Indian_eagle_owl_wings_spread
অতিকায় এই পেঁচাটিকে গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে দেখা যায় নি, এমনকি কোন দিন বাংলাদেশে ছিল কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, তবে কাছাকাছি অঞ্চলে হিসেবে ভারতের আসামে বাংলা পেঁচাকে দেখা গেছে। যদি কোনদিন বাংলাদেশে তার আগমনের প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে তাকে নিয়েও অন্যদের মত তথ্যময় ফিচার আসবে আশা রাখি। ব্যবহৃত আলোকচিত্র নেট হতে সংগৃহীত।
১১) Red-cheeked Cordonbleu, Uraeginthus bengalus
Cordonbleu
এই রূপবান ক্ষুদে পাখিটির নাম বাংলার নামে রাখা হলেও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে পাখিটি আফ্রিকান সাহারা অঞ্চলের! কোন ভাবে বিজ্ঞানীদের ভ্রান্ত ধারণা হয়েছিল যে পাখিটি বাংলার! ব্যবহৃত চিত্রকর্মটি নেট থেকে সংগৃহীত।

সুত্রঃhttp://bornelegant.wordpress.com/2012/05/19/
বিস্তারিত পড়ুন ... »

সাহারার পেছনে যাহারাই থাকুন, আমরা দেবই পাহারা

আমার এক ঘনিষ্ট বোকা বন্ধু আজ সন্ধ্যায় মিনতি করে বলেছে, আমি যেন সাহারা গ্রুপের ব্যবসায়ী উদ্যোগের বিরুদ্ধে কোনো উচ্চবাচ্য না করি। আমি ভাবলাম, সে বোধহয় সাহারা গ্রুপের ঢাকা অফিসে চাকুরি টাকুরি নিয়ে ফেলেছে, তাই এই মিনতি। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা মিনতির যে কারণটি সে বলল, তাতে সত্যি সত্যই চমকালাম। সে বলল, ‌'দোস্ত, ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বললে তুই যে কোনোদিন গুম হয়ে যাবি। ইন্ডিয়া এদেশে তাদের স্বার্থ রক্ষায় যে কোনো কাজ করতে তৎপর। বারবার ঘু ঘু ধান খেয়ে গেলেও ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে ধান খেতে যাস না, পরাণে বধ হয়ে যাবি।'

আমার চমকাবার কারণ এখানেই। আমি এখনও বিশ্বাস করি না যে ভারতের বিরুদ্ধে একটা কিছু লিখলেই কেউ এই দুনিয়া থেকে নাই হয়ে যেতে পারে। আমার মতো তুচ্ছ লেখকের তুচ্ছ ব্লগ পড়ার মতো সময়ও কোনো বড় মানুষের আছে, এটাও আশা করার কোনো কারণ নেই।

কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেকেই হয়তো তা-ই ভাবে,নইলে আমার এই বন্ধুটি এরকম করে বলত না। আমি আমার পাঠককে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, এই বন্ধুটি বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সমর্থক নয়, সুতরাং অভ্যস্ত রাজনৈতিক চিন্তা থেকে এই ভাবনা আসেনি।

ভারত সম্পর্কে এরকম ভীতি যদি ছড়াতে থাকে সেটি সুখের কথা নয়। কিন্তু দিনে দিনে এই ভীতি বাড়ছে, এটাও বোধহয় এক দুঃখজনক বাস্তবতা। কেন এমন হচ্ছে সেটা বিতং করে লেখার আগ্রহ পাচ্ছি না, আমরা সবাই তা কমবেশি জানি। আজকেও জানলাম, কলকাতার জামাই ষষ্ঠিতে যাতে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় এজন্য মমতা বন্দোপাধ্যায় নাকি ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে ফেলেছেন। সুতরাং তিস্তার পানি আসুক কি না আসুক, ফারাক্কার বাঁধে ছোট্ট এক ফাটল নিয়ে মমতা যতই নোংরামি করুন, আমরা দিদিকে জামাই ষষ্ঠির ইলিশ দিতে গাড়ি ঠিকই রওনা করিয়ে দিয়েছি। নিজের দেশের চেয়ে পরের দেশের প্রতি প্রেমটা যে আমাদের বেড়ে যাচ্ছে, সেটা নিয়ে সতর্ক হওয়ার কারণ রয়েছে।

যাই হোক, সংক্ষেপে মূল কথায় চলে আসি। আজকে সাহারা গ্রুপের প্রধান ব্যক্তি সুব্রত রায় সাহারা হোটেল রূপসী বাংলায় তার বাংলাদেশী কোম্পানির শুভ উদ্বোধন করেছেন। বাংলাদেশে তার ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখবেন শেখ সেলিমের সুযোগ্য পুত্র শেখ ফাহিম। এই নিয়োগ আবার আড়ম্বরের সঙ্গে হয়েছে, অনুষ্ঠানে বিজনেস কার্ড তুলে দেয়া হয়েছে ফাহিমের হাতে। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে এদেশে সাহারা গ্রুপের গতি শুধু চলা শুরু করবে না, রীতিমতো দৌঁড়াবে। সে দৌঁড়াক, সবাই ব্যবসা বানিজ্য করে খাক, আমার আপত্তি নেই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কতটাকা বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে সাহারা গ্রুপ? মাত্র ১২০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন তাঁরা। এই যে আবাসন, আইটি, পর্যটন, চিকিৎসা সব ব্যবসায় একেবারে ফর্দাফাই করে দেয়ার স্বপ্ন দেখছেন এবং দেখাচ্ছেন জনাব সাহারা বাবু, এর বাকি টাকা আসবে কোথা থেকে? বাংলাদেশ থেকেই।

সাহারা প্রথমে শুরু করতে চাচ্ছে আবাসন ব্যবসা দিয়ে। গোটা একটা নগর গড়ে তোলার জন্য তাঁরা ৩ লাখ বিঘা জমি চেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নাকি বলেছেন নদী ড্রেজিং করে জায়গা তৈরি করে দেয়া সম্ভব। বাপরে বাপ।

যাক গে, আমি এই প্রশ্ন তুলতে যাচ্ছি না যে জমি যদি দেয়াই যায়, তাহলে সাহারা লাগবে কেন, একটা নগর গড়ে তুলতে তো সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছাই যথেষ্ঠ হওয়ার কথা। কিছুদিন আগে পূর্বাচলের জমি নিয়ে যেমন কাড়াকাড়ি দেখেছি, তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় তেমন নগরী গড়ার উদ্যোগ নিলে এদেশের মানুষের টাকাতেই সেটি তৈরি করা সম্ভব। প্লট বরাদ্দের আবেদনের সময় ভিড়ে ঢাকা শহরে যানজট লেগে যায়। ইনফ্যাক্ট সাহারা তো তা-ই করবে। কইয়ের তেলে কই ভেঁজে আবাসনের ব্যবসা তো এদেশে হচ্ছেই।

তবে এই ব্লগ লেখার কারণ আসলে এসব বকর বকর করা নয়। এই ব্লগ লেখার আসল কারণটি এখন বলি। সুব্রত রায় সাহারার একটা কথা আমার ভালো লাগেনি।

তিনি সুন্দরবনের পাশেও একটা টুরিস্ট নগরী গড়ে তুলতে চেয়েছেন। বিষয়টি যে সুবিধার নয়, সেটি তার নিজের কথাবার্তাতেই আশংকা জেগেছে। তিনি পরিবেশবাদীদের বিষয়ে অত্যন্ত অপমানজনক ভাবে বলেছেন, 'সুব্রত সাহারা বলেন, বেশিরভাগ পরিবেশবাদী শুধু শুধুই ঝামেলা করেন, তারা সমাধান দেন না। শুধু ঝগড়া করেন। তাই সুন্দরবনে পর্যটন সিটিতে তারা বাধা দিলেও সমস্যা হবে না। কারণ তারা অনেকেই তো দোকান খুলে বসে আছেন। ভারতেও তারা অনেক সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।’

আমার ব্লগ লেখার কারণ আসলে এটুকুই। আমি শুধু বলতে চাই, 'এক্সকিউজ মি জনাব সুব্রত বাবু। আপনি সম্ভবত ভুল জায়গায় নক করে ফেলেছেন। সুন্দরবন আমাদের পরিবেশবাদীদের একক সম্পত্তি নয়, এটি আমাদের গোটা বাংলাদেশের সম্পত্তি। আপনি নদী ড্রেজিং করে লাখলাখ একর জায়গায় নগর ফগর তৈরি করছেন, সেটা না হয় আমরা মুখ বন্ধ করে মেনে-ই নেব; কিন্তু সুন্দরবন নিয়ে চুদুর ভুদুর করতে আইসেন না। সুন্দরবন নষ্ট করে টাকা কামানোর কোনো স্বপ্ন যদি আপনি দেখে থাকেন, তাহলে আজ রাতেই সেটি ভুলে যান। সুন্দরবন নিয়ে কিছু করতে চাইলে ব্যাপারটা হয়তো আপনার জন্য যথেষ্ঠ পরিমান অসুন্দর হয়ে পড়বে। আপনাকে কানে কানে বলে রাখি-সুন্দরবনে কিন্তু বাঘ থাকে।'

এই ফালতু ব্লগটা লেখার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, নগদা নগদ শুধু এই সতর্কবানীটুকু জারি করে দেয়া।

 সুত্রঃhttp://www.amarblog.com/arifjebtik/posts/148053
বিস্তারিত পড়ুন ... »

১৫ মে, ২০১২

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল নিজেই অসুস্থ: জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন

চট্টগ্রাম বন্দর হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৬ সালে। বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় জনসাধারণের চিকিৎসাসেবা প্রদানের মহান লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল বর্তমানে নিজেই মুমুর্ষ অবস্থায় নিপতিত। এখানে প্রতিবছরই নতুন ডাক্তার নিয়োগ হয় এবং বছর শেষে চাকুরী ছেড়ে ডাক্তার চলে যায় অন্যত্র। কর্তৃপক্ষের টাকায় কেনা ঔষধ নিতে একই ব্যক্তিই ভুয়া রোগী হয়ে আসে প্রতিদিন। ১৯৮৪ সালে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হলেও এখানে নেই কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিংবা পদ্ধতিগতভাবে কার্যকর আলাদা আলাদা ওয়ার্ড। কোটি টাকা ব্যয়ে পরিচালিত নাম মাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালটি বর্তমানে শুধুমাত্র প্রাথমিক চিকিৎসার কাজটুকুই করে যাচ্ছে। জরুরী বিভাগে গুরুতর কোন রোগী আসলে তা শুধু অন্যান্য হাসপাতালে রেফার করে দেয়া ছাড়া কর্মরত ডাক্তারদের কিছুই করার থাকে না। বর্তমানে হাসপাতালটিতে সর্বমোট নয়জন মহিলা ডাক্তারসহ আটাশ জন চিকিৎসক এবং একচল্লিশ জন নার্স কর্মরত রয়েছেন। অনুসন্ধান করে জানা যায় পদোন্নতির ব্যবস্থা না থাকা, কর্মরত চিকিৎসকদের পেশাগত উন্নয়নের সুবিধা না থাকা, দুর্নীতি, চিফ মেডিকেল অফিসারের পশ্চাতমুখী চিন্তাধারা এবং সঠিক পরিকল্পনা আর অদক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে চিকিৎসরা দীর্ঘদিন এই হাসপাতালে অবস্থান করতে অনীহা প্রকাশ করে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডাক্তার বন্দর হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করেছিলেন পঁচিশ বছর আগে। জাতির দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের একজন মেধাবী ছাত্র এমবিবিএস পাশ করে বন্দর হাসপাতালে যে পদে যোগদান করেছিলেন পঁচিশ বছর পর তিনি একই পদে থাকা অবস্থায় অবসর গ্রহণ করছেন গত জানুয়ারীতে। জাতির সেরা মেধাবী ছাত্র হিসেবে ডাক্তারটিরও বিরাট সম্ভাবনা ছিলো কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ / প্রফেসর হয়ে কর্মস্থল থেকে অবসর গ্রহণ করার। শুধুমাত্র পরিবেশ এবং সুযোগের অভাবে তিনি জাতির চাহিদা পুরণে ব্যর্থ হয়েছেন। এক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত ব্যর্থতা যেমন রয়েছে, তেমনি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষসহ রাষ্ট্রিয় ব্যর্থতাও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। এখানে কর্মরত চিকিৎসকদের পেশাগত উন্নয়ণে এফসিপিএস কিংবা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনে নিরুৎসাহিত করার ঘটনাও রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অপর একজন মহিলা ডাক্তার বন্দর হাসপাতালে যোগদান করার পূর্বে শিশু বিষয়ে এফসিপিএস (শিশু), পার্ট - ১ পাশ এবং চুড়ানত্ম পরীক্ষা দেয়ার জন্য তিন বছর প্রশিক্ষণও সম্পন্ন করেন। বন্দর হাসপাতালে যোগদান করে তিনি দেড় বছর চাকুরী করেছেন, তবুও ছুটি মিলেনি এফসিপিএস ফাইনাল পরীক্ষা দিতে যাওয়ার। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বন্দর হাসপাতালের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা (সিএমও) তার জীবনের বঞ্চনার কথা ষ্মরণ করে বলেছেন, আমি কাউকে এফসিপিএস করার জন্য যেতে দেব না, এফসিপিএস এখানে প্রয়োজন নেই। অথচ বন্দর হাসপাতাল প্রবিধানে বা আইনী কোন বাধা না থাকা সত্ত্বেও তিনি সজোরে বাধা দিয়েছেন অপর মহিলা সহকর্মীর পেশাগত উন্নয়ণে। এ যেন অনেকটা শাশুড়ী তার শাশুড়ী কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে ছেলের বউয়ের উপর প্রতিশোধ নেয়ার মতো। এই ঘটনার পরে অবশ্য অনেক কাটখড় পুড়ে প্রথম ব্যাচ হারিয়ে, অনেক টাকা গচ্ছা দিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে মহিলা ডাক্তারটি তার ন্যায্য পাওনা এফসিপিএস ফাইনাল কোর্সে যোগদানে সমর্থ হয় আরো ছয়মাস পরে। ডাক্তার হয়ে অন্য ডাক্তারের পেশাগত উন্নয়ণে বাধাগ্রস্থ করা কখনো কাম্য হতে পারে না। এখানে যে চিত্র দেখা যায়, নারীর উন্নয়ণে নারীরাই বাধাগ্রস্থ করছে সচেতন কিংবা অবচেতন মনে। এই হীনমন্যতা শুধু বঞ্চিত মহিলা ডাক্তারটির ব্যক্তিগত উন্নয়ণ বাধাগ্রস্থ করেনি, পুরো দেশের নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর উন্নয়ণসহ গোটা জাতির মানবসম্পদ উন্নয়ণে অপুরণীয় ক্ষতি সাধন করবে। এই বাধা চিকিৎসা জগতে একজন নারীর নেতৃত্ব অংকুরেই বিনষ্ট করার সমতুল্য মনে করছেন সচেতন মহল। এই ব্যাপারে অনেক চেস্টা করেও চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) অঞ্জনা দত্তের সাথে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। কর্মরত ডাক্তাররা যদি নিজের পেশাগত উন্নয়ণে উচ্চতর ডিগ্রি গ্রহণ করতে না পারেন তাতে ব্যক্তিগত ক্ষতি যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে জাতিয় ক্ষতি। এতে করে দেশ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটে পড়বে এবং একজন মেধাবীর মেধার অপচয়ও ঘটে।

বন্দরে কর্মরত প্রকৌশলীরা অহরহ দেশী-বিদেশী উচ্চতর প্রশিক্ষণ করার সুযোগ পেলেও ডাক্তারদের ক্ষেত্রে চরম উদাসীন্য পরিলক্ষিত হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বন্দর কর্তৃপক্ষ যন্ত্রের প্রতি যতটা মনোযোগী মানুষের প্রতি ততটা মনোযোগী নয়। যদিও যন্ত্র পরিচালনায় মানুষের সুস্থতা এবং কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করা প্রধান শর্ত। সুতারাং বন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রকৌশলীদের কর্মক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে হাসপাতালের উন্নয়ণ অপরিহার্য। চবক হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের পেশাগত উন্নয়ণ ছাড়া হাসপাতালের উন্নয়ণ কখনো সম্ভব নয় বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।


চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বড়মাপের রাজস্ব আয়ের প্রতিষ্টান। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণমুলক সেবা নিশ্চিত করা প্রতিষ্ঠানটির কর্তব্য। বন্দর হাসপাতালে কর্মকতা-কর্মচারীদের পাশাপাশি বন্দর এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণও চিকিৎসাসেবা পাওয়ার অধিকার রাখেন। চবক হাসপাতাল শুরুতে সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও বর্তমানে বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যতীত বাইরের জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বন্দরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা স্থাপন এবং রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনগণের অনেক ত্যাগ ও সহযোগিতা রয়েছে। বন্দর হাসপাতালটিতে বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাড়া বাইরের জনগণের চিকিৎসা প্রাপ্তি বন্ধ করে দেয়ায় চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণাঞ্চলে বসবাসকারী জনগণ বর্তমানে জরুরী চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভয়ংকরভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। শহরের দক্ষিণভাগে সরকারী কোন গণহাসপাতাল কিংবা ভাল ক্লিনিক নেই যে, উক্ত এলাকার জনগণ বিপদ-আপদ, রাত-বিরাতে জরুরী চিকিৎসা নিতে পারে। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, বিশাল অংকের বাজেটে পরিচালিত বন্দর হাসপাতালটিতে বন্দর এলাকায় বসবাসকারী জনগণ নয়, খোদ বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জরুরী চিকিৎসা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির এই যুগে শুনতে হাস্যকর মনে হলেও সত্যি, হাসপাতালটিতে যে ডাক্তার দিয়ে ডায়াবেটিক্স চিকিৎসা প্রদান করেন একই ডাক্তার দিয়ে গাইনী, হৃদরোগসহ সকল রোগের চিকিৎসা পরিচালিত করা হয়। প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির সেই বিখ্যাত কবিরাজের মতো করে অসহায় চিকিৎসকরা এখানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। সচেতন জনগন শুনলে অত্যন্ত মর্মাহত হবেন যে, অর্থ আছে, স্থান আছে, সুযোগ আর সম্ভাবনা সবই আছে শুধুমাত্র পরিকল্পনা আর আন্তরিকতার অভাবে অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে হাসপাতালটি।

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ে কম সুযোগ আর সীমাবদ্ধতা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কাঠামো নিয়ে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল। বন্দর হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তারদের অবস্থা বলা যায় অনেকটা “ফাইস্যা গেছি মন্‌কার চিপায়” ধরণের ত্রাহি অবস্থা। প্রতিবার বছর শুরুতে ডাক্তার নিয়োগ হয় আর অধিকাংশ ডাক্তারই নিঃশর্তে চাকুরী ছেড়ে চলে যান বছর শেষে। আবারও নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসে, হাসপাতালটির অবস্থা না বুঝে আবেদন করেন অসংখ্য অভিজ্ঞ বা সদ্য পাশ করা ডাক্তার। বছর জুড়ে চলতে থাকে নিয়োগ প্রক্রিয়া। নিয়োগপ্রাপ্তির বছর না ফুরাতেই তারা বুঝতে পারে পেশাগত জীবন অন্ধকার। পদায়নের সুযোগ না থাকায় সারা জীবন মেডিকেল অফিসার হিসেবেই কালাতিপাত, ফার্মেসীর দোকানদারের মতো বসে বসে ঔষধের নাম লেখা ছাড়া বাইরের চিকিৎসা জগতের কোন কিছুর সাথে তাদের যোগাযোগ করার সুযোগ থাকেনা।বন্দরের যে ধরণের সুযোগ আর অর্থ আছে তা দিয়ে প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশীপ ব্যবস্থায় শহরের দক্ষিণাঞ্চলের জন্য এই হাসপাতালটিকে একটি অত্যন্ত উন্নতমানের মিলিটারী হসপিটাল (সিএমএইচ) এর আদলে রূপান্তর করা সম্ভব। ইতিপূর্বে আমরা পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে জেনেছি, বহুবার বহু আঙ্গিকে এই হাসপাতালটিকে আধুনিক যুগপোযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই যাচাই-বাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার নামে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেয়া অথবা বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

বাংলাদেশে বিশেষ করে সরকারী মেডিকেল কলেজে যে সব ছাত্র-ছাত্রী এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হয় তারা নিঃসন্দেহে দেশের সেরা মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী। দেশের এই মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে পরিবার, দেশ ও জাতি অনেক কিছু আশা করেন এবং পাওয়ার অধিকারও রাখেন। যে পরিবারের একটি ছেলে কিংবা মেয়ে ডাক্তারী পড়েছেন সে পরিবারই সত্যিকারভাবে বুঝতে পারেন যে, একজন এমবিবিএস ডাক্তার তৈরীতে কী পরিমাণ কাটখড় পোড়াতে হয়। দেশের এই সম্ভবনাময় মেধাগুলোর পেশাদারিত্বের উন্নয়ণ বাধাগ্রন্থ করা, বিশেষজ্ঞ হওয়ার পথ রূদ্ধ করা দেশের জন্য কল্যাণকর নয়। এটা অনেকটা পেশাগত ডিগ্রি প্রাপ্ত এমবিবিএস ডাক্তারদের অধিকার লংঘন করার শামিল। বন্দরের পাশ্ববর্তী আগ্রাবাদ এলাকায় বেসরকারী উদ্যোগে পরিচালিত চট্টগ্রাম মা-শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল যেভাবে সীমিত সম্পদ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে জনগণের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তা বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুকরণ করতে পারেন। একজন এমবিবিএস পাশ ডাক্তার অবশ্যই অধিকার রাখেন; কর্ম দক্ষতা, প্রশিক্ষণ আর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে সহকারী প্রফেসর, প্রফেসর হওয়ার মাধ্যমে নিজেকে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তপক্ষ (চবক) দেশের এধরণের মেধাবীদের বন্দরের লজিং মাস্টারের মতো ফেলে রেখে নিতান্তই তাদের অধিকার খর্ব করছেন, পাশাপাশি দেশের মেধা সম্পদ নষ্ট করছেন - যা মোটেও কাম্য নয়।

বন্দর কর্তৃপক্ষ এই হাসপাতালের মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারের বিশ সিটের একটি মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনষ্টিাটউটও চালু করতে পারেন, যাতে করে আমাদের দেশের চিকিৎসক আর নার্স তৈরীর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা পুরণে সহায়ক হয়। বন্দরে নিয়োগকৃত ডাক্তারদের চাকুরীর বয়স এবং যোগ্যতা সাপেক্ষে প্রমোশনের স্তর সৃষ্টিকরণ, একই ডাক্তার দিয়ে যাবতীয় জটিল রোগের চিকিৎসার সনাতনী পদ্ধতি পরিহার, প্রতিটি ডাক্তারকে আলাদা বিষয়ে নিয়োজিত করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এফসিপিএস ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞ তৈরীর পথ সৃষ্টি করা যায়। এধরণের যুগোপযোগী পরিকল্পনা কিংবা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হাসপাতালটির উন্নয়ণ ঘটানো গেলে বন্দর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ও আশ-পাশের জনসাধারন যেমন সূ-চিকিৎসার সুযোগ পাবে, তেমনি দেশে সৃষ্টি হবে বিভিন্ন রোগের ভাল ভাল বিশেষজ্ঞ। বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অনতিবিলম্বে পরিবর্তন না করলে প্রতিবছরই ডাক্তার নিয়োগ হবে আর অল্প ক’দিন পর চলে যাবে অন্যত্র। অবশ্য ডাক্তারদের এই গমনাগমনে বন্দর, দেশ কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির বিশাল ক্ষতি সাধিত হলেও একশ্রেনীর অসাধু দুস্কৃতিকারীর লাভ আছে বলে অনেকেই মনে করেন। বর্তমানে হাসপাতালে যে সমস্ত ডাক্তাররা কর্মরত আছেন তারা অনেকটা পিঞ্জিরাবন্দী পাখি কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষের জায়গীর মাস্টাররের মতো। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে কেনা ঔষধগুলোর নাম লিখাই যেন দেশের এই সেরা মেধাবী মানুষগুলোর কাজ। চট্টগ্রামের সাংসদ, রাজনীতিবিদ, বন্দরের সিবিএ নেতৃবৃন্দ, নৌ-মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ চট্টগ্রামের সচেতন জনগণ, সাংবাদিক ভায়েরা এগিয়ে আসলে পরিবর্তন আশা করা যায়। আসুন আমরা জাতির এই মেধাবী মানুষগুলোর মেধা ধ্বংস করা পরিহার করে মেধাগুলো আরো শানিত করে জাতীয় জীবন সমৃদ্ধ করি । মেধার সন্মান আর যথোপযুক্ত ব্যবহার ছাড়া দেশে মেধার বিকাশ কখনো সম্ভব নয়। আবহাওয়া পরিবর্তন আর ওজন স্তরের ক্ষয় হওয়ায় রোগের প্রকৃতি ও জটিলতা পরিবর্তনের সাথে সাথে চিকিৎসা পদ্ধতি বিশেষায়িত করার কোন বিকল্প নেই।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল নিজেই গুরুতর অসুস্থ: জরুরী চিকিৎসা প্রয়োজন।



সুত্রঃ  http://prothom-aloblog.com/posts/55/158982(ঈষৎ সংক্ষেপিত)


বিস্তারিত পড়ুন ... »

bdnews24.com - Home

ইরান বাংলা নিউজ

বিবিসি বাংলা

দৈনিক সংগ্রাম