খুব হিংসা হয় যখন দুই বন্ধুকে দেখি মন খুলে প্রাণ খুলে হেসে হেসে মনের
কথা বলছে। আমার সারা জীবনেও সৌভাগ্য হয়নি কারো সাথে মন খুলে কথা বলার।
বাস্তবতার চাপেই হোক, কি পরিবেশের প্রভাবেই হোক অথবা নিজের বানানো বিভাজনের কারণেই হোক, অনেকগুলো বলয় নিয়ে আমাদের চলতে হয়। বন্ধুদের বলয়, সহকর্মীদের বলয়, সহপাঠীদের বলয় বা পরিচিতদের বলয়। এগুলো ম্যানেজ করে সবাই চলছে, কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমার ব্যাপারটা হয়তো একটু আলাদা। খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক প্রথা আর সামাজিক প্রথা, এ দুইয়ের সাথে মিশে চলতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক প্রথা সামাজিক প্রথার সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে। আবার কোথাও সামাজিক প্রথার সাথে সংঘর্ষ লেগেছে পারিবারিক প্রথার। বাবা-মা চেয়েছেন আমাদের একভাবে গড়ে তুলতে, সে শিক্ষা আবার বাড়ির বাইরে এসে দেখি পুরোই অন্যরকম। ওখানকার শিক্ষার সাথে বাসার ভেতরের শিক্ষার মিল নেই। একটা বয়স পর্যন্ত এগুলো মিলিয়ে চলা যায়, সমস্যা হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে, বড় হবার সাথে সাথে ব্যাপারগুলো আরও ব্যবহারিক হয়ে উঠতে থাকে এবং বেছে নিতে হয় যে কোন একটিকে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে আমার সাথের ছেলেপেলেদের দেখেছি, পরবর্তীতে এ দুয়ের কোন একটিকে বেছে নেয় এবং সেইমত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়। আমার সীমাদ্ধতাগুলোর একটি হলো, এ দুয়ের কোনটিকেই অস্বীকার করার মত মানসিক জোর আমার ছিলনা, এখনো নেই। যার কারণে ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না’ জাতীয় সমস্যায় আমাকে থাকতে হয়েছে সারাজীবন, এখনো থাকতে হয়।
বাইরের গন্ডির দুনিয়ায় আমার ভাল বন্ধু আছে বেশ কয়েকজন। সেখানকার ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি তাদের সাথে প্রায়ই কথা বলি। আর নিজের পারিবারিক গন্ডিতে ফিরলে আমার আচরণ হয় আরেকরকম, সেখানে আমার সত্ত্বা আলাদা। ভেতর-বাইরের মধ্যে ব্যালেন্স থাকলে কথা ছিল, মিলিয়ে চলা যেত। কিন্তু দুটোর মধ্যে ইমব্যালেন্সিংয়ের পরিমাণ এত বেশি, যে সেটা ভাবতেও ভয় লাগে। এক দিকে যেটা খুবই স্বাভাবিক, অন্যদিকে সেটাই নিষিদ্ধ, আবার অন্যদিকের নিষিদ্ধ ব্যাপারগুলো এদিকে কোন ব্যাপারই না। এ দুই পক্ষকে সন্তষ্ট রাখতে গিয়ে ক্রমাগত পিষ্ট হতে হয় আমাকে। আমার বোঝার বয়সের পর থেকে এই দুই পক্ষের ডিমান্ডগুলো হাসিমুখে পালন করতে গিয়ে নিজেকে এখন একজন দাসের চাইতে বড় কিছু মনে হয় না। ভেতরকার উদ্গত কষ্টগুলো, অসহ্য ব্যাথাগুলো খুলে বলার মত কাউকে খুঁজে পাই না। কাকে বলবো? এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষের অনুভূতিগুলো অর্থহীন, হাস্যকর রকমের মূল্যহীন।
সারাদিন হয়তো অনেক কাজ করি। কিন্তু আমার কাছে সেগুলো একজন আজ্ঞাবহ বোবা দাসের কাজের চাইতে বেশি কিছু মনে হয় না। সরলপ্রাণ, বোবা একজন দাসকে দিয়ে যেমন সবাই ইচ্ছামত কাজ করিয়ে নেয়, আমার অবস্থা ঠিক সেরকম। কোন কিছুর বিপরীতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, কোন কিছুকে অস্বীকার করার ক্ষমতা, কোন জিনিস থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা যার নেই, সে ছাড়া কেউ বুঝবে না, মনে কতো ছাইচাপা কষ্ট নিয়ে কেউ দাসত্ব করে। দাসের নিজের যে একটা সত্ত্বা আছে, সেটা নিয়ে কেউ ভাবে না। ওদিককার লোকেরা ভাবে, আরে ওতো আমাদেরই লোক, এটা করাও, সেটা করাও। আর এদিককার লোক মনে করে, এ তো নিজেদেরই লোক, করাও তাকে দিয়ে ইচ্ছামত কাজ। বোবা দাসটা তখন বলতেও পারেনা, এই দুই বিপরীত পরিবেশের চাপে সে কতটা পিষ্ট হচ্ছে। কতদিন এমন গিয়েছে, মনে অনেক যন্ত্রণা, অনেক অস্থিরতা মাথায় নিয়ে বন্ধুর সাথে হাসিমুখে কথা বলেছি, পিঠ চাপড়ে দিয়েছি, বলেছি নো প্রবলেম! ব্যাটা ভেবে নিয়েছে, আমি কতই না সুখে আছি! নিজের ভেতরকার কথাগুলো কাউকে বলতে গিয়েও থমকে গিয়েছি। বলে কি লাভ, কেউ বুঝবেনা। মুখে জোর করে হাসি এনে তাদেরই দাসত্ব করতে থাকি।
তাই নিজের যন্ত্রণায় পুড়তে হয় নিজেকেই। একটা বস্তাকে দড়ি বেধে টানলে সে একদিকেই যায়। কিন্তু তাকে যদি পাঁচটা রশি বেঁধে পাঁচদিক থেকে টানা হয়, ছিন্নভিন্ন হওয়া ছাড়া তার কোন উপায় থাকে না। এরকম ছিন্নভিন্ন হয়ে চলেছি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। মহাকাল আমাকে দিয়ে আর কতকাল রশি টানাটানি খেলবে, সে অপেক্ষায় দিন গুনি।
কথায় বলে, বোবার শত্রু নেই। কথাটা সত্য নয়। বোবার শত্রু আছে, কিন্তু সেকথা প্রকাশ করার ক্ষমতা তার নেই।
পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক। দুয়েকটা বোবা প্রাণী কি ভাবলো তাতে কার কি আসে যায়?
বাস্তবতার চাপেই হোক, কি পরিবেশের প্রভাবেই হোক অথবা নিজের বানানো বিভাজনের কারণেই হোক, অনেকগুলো বলয় নিয়ে আমাদের চলতে হয়। বন্ধুদের বলয়, সহকর্মীদের বলয়, সহপাঠীদের বলয় বা পরিচিতদের বলয়। এগুলো ম্যানেজ করে সবাই চলছে, কোথাও কোন সমস্যা হচ্ছে না। আমার ব্যাপারটা হয়তো একটু আলাদা। খুব ছোটবেলা থেকেই পারিবারিক প্রথা আর সামাজিক প্রথা, এ দুইয়ের সাথে মিশে চলতে হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পারিবারিক প্রথা সামাজিক প্রথার সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে। আবার কোথাও সামাজিক প্রথার সাথে সংঘর্ষ লেগেছে পারিবারিক প্রথার। বাবা-মা চেয়েছেন আমাদের একভাবে গড়ে তুলতে, সে শিক্ষা আবার বাড়ির বাইরে এসে দেখি পুরোই অন্যরকম। ওখানকার শিক্ষার সাথে বাসার ভেতরের শিক্ষার মিল নেই। একটা বয়স পর্যন্ত এগুলো মিলিয়ে চলা যায়, সমস্যা হয় না। কিন্তু আস্তে আস্তে, বড় হবার সাথে সাথে ব্যাপারগুলো আরও ব্যবহারিক হয়ে উঠতে থাকে এবং বেছে নিতে হয় যে কোন একটিকে। বেশিভাগ ক্ষেত্রে আমার সাথের ছেলেপেলেদের দেখেছি, পরবর্তীতে এ দুয়ের কোন একটিকে বেছে নেয় এবং সেইমত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ায়। আমার সীমাদ্ধতাগুলোর একটি হলো, এ দুয়ের কোনটিকেই অস্বীকার করার মত মানসিক জোর আমার ছিলনা, এখনো নেই। যার কারণে ‘বাহির বলে দূরে থাকুক, ভিতর বলে আসুক না’ জাতীয় সমস্যায় আমাকে থাকতে হয়েছে সারাজীবন, এখনো থাকতে হয়।
বাইরের গন্ডির দুনিয়ায় আমার ভাল বন্ধু আছে বেশ কয়েকজন। সেখানকার ব্যাপারগুলো নিয়ে আমি তাদের সাথে প্রায়ই কথা বলি। আর নিজের পারিবারিক গন্ডিতে ফিরলে আমার আচরণ হয় আরেকরকম, সেখানে আমার সত্ত্বা আলাদা। ভেতর-বাইরের মধ্যে ব্যালেন্স থাকলে কথা ছিল, মিলিয়ে চলা যেত। কিন্তু দুটোর মধ্যে ইমব্যালেন্সিংয়ের পরিমাণ এত বেশি, যে সেটা ভাবতেও ভয় লাগে। এক দিকে যেটা খুবই স্বাভাবিক, অন্যদিকে সেটাই নিষিদ্ধ, আবার অন্যদিকের নিষিদ্ধ ব্যাপারগুলো এদিকে কোন ব্যাপারই না। এ দুই পক্ষকে সন্তষ্ট রাখতে গিয়ে ক্রমাগত পিষ্ট হতে হয় আমাকে। আমার বোঝার বয়সের পর থেকে এই দুই পক্ষের ডিমান্ডগুলো হাসিমুখে পালন করতে গিয়ে নিজেকে এখন একজন দাসের চাইতে বড় কিছু মনে হয় না। ভেতরকার উদ্গত কষ্টগুলো, অসহ্য ব্যাথাগুলো খুলে বলার মত কাউকে খুঁজে পাই না। কাকে বলবো? এক পক্ষের কাছে অন্য পক্ষের অনুভূতিগুলো অর্থহীন, হাস্যকর রকমের মূল্যহীন।
সারাদিন হয়তো অনেক কাজ করি। কিন্তু আমার কাছে সেগুলো একজন আজ্ঞাবহ বোবা দাসের কাজের চাইতে বেশি কিছু মনে হয় না। সরলপ্রাণ, বোবা একজন দাসকে দিয়ে যেমন সবাই ইচ্ছামত কাজ করিয়ে নেয়, আমার অবস্থা ঠিক সেরকম। কোন কিছুর বিপরীতে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, কোন কিছুকে অস্বীকার করার ক্ষমতা, কোন জিনিস থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা যার নেই, সে ছাড়া কেউ বুঝবে না, মনে কতো ছাইচাপা কষ্ট নিয়ে কেউ দাসত্ব করে। দাসের নিজের যে একটা সত্ত্বা আছে, সেটা নিয়ে কেউ ভাবে না। ওদিককার লোকেরা ভাবে, আরে ওতো আমাদেরই লোক, এটা করাও, সেটা করাও। আর এদিককার লোক মনে করে, এ তো নিজেদেরই লোক, করাও তাকে দিয়ে ইচ্ছামত কাজ। বোবা দাসটা তখন বলতেও পারেনা, এই দুই বিপরীত পরিবেশের চাপে সে কতটা পিষ্ট হচ্ছে। কতদিন এমন গিয়েছে, মনে অনেক যন্ত্রণা, অনেক অস্থিরতা মাথায় নিয়ে বন্ধুর সাথে হাসিমুখে কথা বলেছি, পিঠ চাপড়ে দিয়েছি, বলেছি নো প্রবলেম! ব্যাটা ভেবে নিয়েছে, আমি কতই না সুখে আছি! নিজের ভেতরকার কথাগুলো কাউকে বলতে গিয়েও থমকে গিয়েছি। বলে কি লাভ, কেউ বুঝবেনা। মুখে জোর করে হাসি এনে তাদেরই দাসত্ব করতে থাকি।
তাই নিজের যন্ত্রণায় পুড়তে হয় নিজেকেই। একটা বস্তাকে দড়ি বেধে টানলে সে একদিকেই যায়। কিন্তু তাকে যদি পাঁচটা রশি বেঁধে পাঁচদিক থেকে টানা হয়, ছিন্নভিন্ন হওয়া ছাড়া তার কোন উপায় থাকে না। এরকম ছিন্নভিন্ন হয়ে চলেছি প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। মহাকাল আমাকে দিয়ে আর কতকাল রশি টানাটানি খেলবে, সে অপেক্ষায় দিন গুনি।
কথায় বলে, বোবার শত্রু নেই। কথাটা সত্য নয়। বোবার শত্রু আছে, কিন্তু সেকথা প্রকাশ করার ক্ষমতা তার নেই।
পৃথিবীর সকল প্রাণী সুখী হোক। দুয়েকটা বোবা প্রাণী কি ভাবলো তাতে কার কি আসে যায়?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন