বর্তমান মানব সভ্যতার পিছনে যে কয়টি শহর ও সংস্কৃতির অবদান অনস্বীকার্য
তাদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রগামীদের অন্যতম রোম। প্রায় তিন হাজার বছর আগে
যাত্রা শুরু করা এই তিলোত্তমা শহর গত দুই হাজার বছর ধরে ইউরোপ তথা সমগ্র
বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র। এই শহরেই গোড়াপত্তন ঘটে রোমান সভ্যতার, যা শাসন
করেছে তৎকালীন জানা বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশী, যার অবদান আমরা এখনো
প্রতিনিয়ত অনুভব করি প্রতিদিনের নিত্য জীবনে। চলুন পাঠক ঘুরে আসি সাত
পাহাড়ের শহর রোম থেকে যাকে বলা হয় আধুমিক সভ্যতার জন্মক্ষেত্র।
স্বপ্ননগরী রোমে পা দিলাম আমরা এক সন্ধ্যায়, আমরা বলে আমি আর ইতালির বোলগনা বিশ্ব- বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মণি ভাই। বেশী আঁধার হয়ে আসায় আর কোথাও ঘোরাঘুরি না করে রেলস্টেশনের কাছেই এক হোটেলে আস্তানা গাড়লাম সেই রাতের মত, তবে হোটেল রিসেপ্সনিস্টের কাছে থেকে জেনে নিতে ভুললাম না কিভাবে পরদিন প্রথম গন্তব্য বিশ্বের বিস্ময় রোমের কলোসিয়ামে পৌঁছাব যা আমাদের হোটেল থেকে পদব্রজে মাত্র মিনিট দশেকের পথ।
পরদিন সূর্যিমামা গগনের কোনে উকি দেওয়ার পরপরই আমরা ম্যাপ হাতে চললাম কলোসিয়ামের পানে।এই গলি, সেই গলি, এই রাস্তা, সেই রাস্তা পার হয়ে অবশেষে এক মোড় ঘুরতেই নজরে আসল চিরচেনা কলোসিয়ামের বিশাল অবয়ব, ইতিহাস যেন থমকে গেছে এইখানে।

এই সাতসকালেও দেখি আমাদের আগে বেশ কিছু্ দর্শনার্থীর ভিড়, বিশাল লাইন হয়ে গেছে প্রায় ২০০০ বছর আগে নির্মিত তৎকালীন এই অ্যারেনা বা স্টেডিয়ামে ঢোকার জন্য। উল্লেখ্য, এইটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার। ৫০,০০০ মানুষের ধারনক্ষমতা সম্পন্ন এই অ্যারেনা মূলত ব্যবহৃত হত লোকসমাগম, রাজকীয় ভাষণ, নাটক আর বিনোদনের নানা আসরের জন্য, বিশেষ করে ইতিহাস কুখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর মল্লযুদ্ধের কারণে। বিশ্বের মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এই রোমান স্থাপত্য আসলেই মনে অপার বিস্ময়ের উদ্রেক করে, আজ ২০০০ বছর পরেও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়সহ প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প আর পাথরচোরদের দৌরাত্ন উপেক্ষা করে কালের করাল গ্রাসের নানা সাক্ষী আপন শরীরে নিয়ে আমাদের সামনে তা গর্বভরে দাড়িয়ে থাকে অতীত ও আধুনিক যুগের মিলনকেন্দ্র হয়ে। অবশেষে ভিতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয় আমাদের সেই বিস্ময়ের বিস্ময়ে, সারি সারি গ্যালারী, কুলীন আর সাধারণ জনগণের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা আর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সিজার আর সিনেটরদের জন্য আলাদা আলাদা বিলাসবহুল কক্ষ।
অ্যারেনার কেন্দ্রস্থলে প্রায় গোলাকৃতির এক মাঠ থাকার কথা যেমনটা আমরা সাধারণত চলচ্চিত্রে আর চিত্রকর্মে দেখে থাকি কিন্তু সময়ের ভারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কলোসিয়ামটির পাটাতন ভেঙ্গে পড়েছে অনেক অনেক আগেই, সেই ভঙ্গুর পরিবর্তনযোগ্য পাটাতনেই মল্লযুদ্ধ হত গ্ল্যাডিয়েটর আর নানা বুনো পশুদের, সেই সাথে যুদ্ধ অনুযায়ী পট পরিবর্তন করা হত প্রায়শই, কখনো মরুভূমি, কখনো জঙ্গল, কখনো বা জলজগৎ। তবে পাটাতনটি ভেঙ্গে পড়ায় তার নিচের স্থাপত্যে আমাদের দৃষ্টি পড়ে অবধারিত ভাবেই, জানা যায় সেখানকার সারি সারি ক্ষুদে কামরাগুলো ব্যবহার হত পশুর খাঁচা, খাদ্যের গুদাম আর গ্ল্যাডিয়েটরদের বিশ্রামাগার ও শরীরচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে।

আর গ্যালারীগুলো ঘুরে ঘুরে যেন সব এসে এক জায়গাতেই মিলিত হয়েছে, এই আশ্চর্যকর স্থাপত্য এমনভাবে তৈরি যেন মাঝের মাঠটাতে সৃষ্টি হওয়া প্রতিটি শব্দ সবচেয়ে উঁচুতে বসে থাকা দর্শকের কানে যেন নিখুঁত ভাবে পৌছায়! প্রাচীন সেই সরু সরু অলি গলিতে মুগ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকি আমরা, সূর্যের তেজালো রশ্মি এসে পড়েছে কলোসিয়েমের অর্ধেকে, অবাক হয়ে ভাবছি যে রোমানদের বলা হয় আধুনিক সভ্যতার জন্মদাতা, যারা বিশ্বকে এনে দিল প্রথমবারের মত গণতন্ত্রের স্বাদ, তারা কিভাবে পারত এই রক্তপাতময় বিনোদনকে উপভোগ করতে? একদল মানুষ যথেচ্ছ ভাবে লড়ে যাচ্ছে প্রাণের দায়ে, অথবা বুনো বাঘ, সিংহ হামলে হামলে খাচ্ছে ক্রীতদাস বা যুদ্ধবন্দীদের, এই অমানুষিক অচিন্ত্যনীয় ঘটনাগুলোও ছিল রোমানদের কাছে নিছকই বিনোদন।

অবশেষে কয়েকঘণ্টা পরে একরকম জোর করেই কলোসিয়াম থেকে বের হয়ে আমরা রওনা দিলাম অন্য গন্তব্যের দিকে। অ্যারেনার মূল দরজার সামনেই দেখা হল একাধিক রোমান সৈন্যর সাথে, আসলে একদল শিল্পী যারা তৎকালীন রোমান সৈন্যদের পোশাক ও নকল অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টহল দিচ্ছে, পর্যটকদের মনোরঞ্জনের এক ফন্দি, অনেকেই সাগ্রহে ছবি তুলছে তাদের সাথে।

কলোসিয়ামের অদূরেই বিশ্বখ্যাত ইতিহাসময় স্থাপত্য রোমান ফোরাম, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যাত্রা শুরু করা সিজারের ভাষণ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয়কাজে ব্যবহৃত এই সুরম্য স্তম্ভ ও ভবনময় এলাকাটি কালের করাল গ্রাসে হারিয়েই যেতে বসেছিল, দুইশ বছর আগেও এর অধিকাংশ স্থান ছিল দশ ফুট মাটির নিচে! ধন্যবাদ ইতালীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের, তাদের অপরিসীম চেষ্টা ও বিপুল অধ্যবসায়ের ফলেই আজ আমরা খানিকটা দেখতে পারছি অতীতের কোল খুঁড়ে বাহির করা এই ইতিহাসস্নাত স্থান। জানলাম জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পরে রোমান সেনাপতি মার্ক অ্যান্টনী এইখানেই দাড়িয়ে রোমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। কি অদ্ভুত অনুভুতি, রোমের সবখানেই ইতিহাসের এমন ছড়াছড়ি! প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতি পদক্ষেপেই আপনি অনুসরণ করতে পারবেন তা।


এরপরে যাত্রাপথে এসে দাড়ায় দিগন্ত আড়াল করে থমকে থাকা অতুলনীয় বিশালত্ব আর সৌন্দর্যের অধিকারী সফেদ মর্মর পাথরের ভবন ভিক্তর ইমানুয়েল মনুমেন্ট। ইতালির নানা রাজ্যকে সর্বপ্রথম এক পতাকার নিচে নিয়ে আসা অবিভিক্ত ইতালির প্রথম রাজা ভিক্তর ইমানুয়েলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২৩০ ফুট উচু ও ৪৪৩ ফুট দীর্ঘ উৎকৃষ্ট মার্বেল পাথরের এই ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩৫ সালে। মূল সিংহদরজার সামনেই এক বেদীর উপরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত এক নাম না জানা সৈনিকের সমাধি, যা ইতালির স্বাধীনতা ও তা রক্ষার্থে প্রাণদানকারীদের প্রতীক। ভেতরে ঢোকার সুতীব্র ইচ্ছা থাকলেও দরজায় দর্শনার্থীদের ভিড় দেখে সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে এগোলাম রোমের প্রাণদানকারী নদী টিবেরের দিকে।

নদীপ্রধান দেশের মানুষ আমি। শৈশব, কৈশোর কেটেছে পদ্মাতীরের রাজশাহীতে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, নাফ, ইছামতী, ধলেশ্বরী কত অসম্ভব সুন্দর নদীগুলো আমাদের চিরসবুজ পলিমাটির দেশটা তৈরি করেছে লক্ষ হাজার বছর ধরে, তাই কোন দেশে গেলেই সেখানকার স্থানীয় নদী দেখার জন্য মন আনচান করে, হয়ত সেই নদীর তীরে ইতস্তত পথ ভুলে বেড়ানো কোন শিশুকে দেখে রোমন্থন করি নিজের শৈশব, পৃথিবীর সব নদীর জেলেকেই মনে হয় অতি আপন পদ্মাপারের জেলে। সোজা কথাই বলি- আমি নদী জমায়। বিভিন্ন চিত্রবিচিত্র নদী, তাদের বাঁক, লোকজন, জীবনযাত্রার সাথে একাত্নতা বোধ করি। এই মুহূর্তে জীবন নামের নদীর বাঁকে সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে টিবের নামের এই ইতিহাসখ্যাত নদী, যা সঞ্জীবনী অমৃত সুধা দিয়ে প্রাণ সঞ্চালন করেছে রোমান সভ্যতায়, যাকে কেন্দ্র করে দুপাশে বিকশিত হয়েছে আধুনিক সভ্যতার আঁতুড়ঘর। সেই দিকেই চললাম টিবেরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
আল্পস পর্বতমালা থেকে যাত্রা শুরু করা ৪০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ টিবের ভূমধ্যসাগরে মোহনায় বিলীন হবার আগ পর্যন্ত প্রায় আঠার হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি উর্বর করে চলেছে অনাদিকাল ধরে আপন স্বকীয়তায়, নিজস্ব ছন্দে কিন্তু তার প্রস্থ মাত্র কয়েকশ মিটার, স্থান বিশেষে আরো কম! ইউরোপের নদী হিসেবে তা ঠিক থাকলেও পদ্মা, মেঘনা, যমুনার দেশের মানুষের কাছে তা কিছুটা শীর্ণকায় বলেই প্রতীয়মান হলেও টিবেরের ইতিহাসখ্যাত অতীতের কারণে মানবজাতির কাছে তার আবেদন থাকে আগের মতই অটুট, অম্লান, আবেদনময়ী।

নদীর উপরে সারি সারি সেতু, প্রত্যেকটিতেই মর্মর পাথরের রেলিং আর সুদৃশ্য সব প্রমাণ আকারের ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। এমন এক সেতুর অন্যপারে দেখলাম দুই হাজার বছরের সমৃদ্ধময় অতীত নিয়ে সগর্বে দণ্ডায়মান ক্যাসল সেন্ট অ্যাঞ্জেলো, দুর্গাকৃতির এই ভবনটি ছিল এক সময়ের বিখ্যাত রোমান সম্রাট হাইড্রিয়ানের সমাধি, পরবর্তীতে তা ব্যবহার হয় দুর্গ, কারাগার ও পোপদের বিপদকালীন সময়ের আবাসস্থল হিসেবে। বর্তমানে সেখানে প্রতিরক্ষা জাদুঘরের অবস্থান।

এমনই আরেক সারি সারি দেবদূতের ভাস্কর্য শোভিত সেতুর অন্য প্রান্তে চোখে পড়ল আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টারত এক অবেলিস্ক স্তম্ভ, তারপর বিশালাকার এক গম্বুজ ও সুরম্যপ্রাসাদ। বুঝলাম চেয়ে আছি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ ভ্যাটিকান সিটির পানে, রোম মহানগরীর মাঝেই যে এর অবস্থান। কিন্তু সে অন্য সময় দেখব এই চিন্তা করেই টিবেরের প্রতি নীরব শ্রদ্ধা জানিয়ে চললাম পিয়াজ্জা ন্যাভনার উদ্দেশ্যে।
রোমের একমাথা থেকে আরেক মাথা পায়ে দলতে দলতে ক্ষিদে পেয়েছে বেশ, কাছে পিঠেই এক রেস্তরা দেখে ঢুকে পড়লাম পেটপূজোর আশায়। ইতালি ভোজনরসিকদের প্রিয় দেশ, রসনাতৃপ্তকারী রকমারি মজাদার খাবারের জন্ম ও বিস্তার এই দেশে। মুখে জল আনা পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি আর কত নাম বলব! সেই সাথে আছে শত শত বর্ণ, গন্ধ, স্বাদের চীজ। মনপ্রাণ উদাস করা এক ধরনের স্প্যাগেটিই খেলাম ভূমধ্যসাগরের খাঁটি জলপাই তেল দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে। সেই সাথে প্রচুর দুধ চিনি দেওয়া বিশেষ ধরনের কফি- ক্যাফে দ্য লাত্তে। রেস্তরাটি অত্যন্ত সুরুচিপূর্ণ ভাবে সাজানো, আধুনিকতার সাথে নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে বিশ্বনন্দিত ক্ল্যাসিক সব চলচ্চিত্রের কিছু আলোকচিত্র, সবই সাদা কালো। এর মাঝে আবার বিশেষভাবে সাজানো রোমে শুটিং করা সিনেমাগুলো যার মধ্যমণি হয়ে আছে প্রিয়মুখ অড্রে হেপবার্ন আর গ্রেগ্ররী পেক অভিনীত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক সিনেমা রোমান হলিডে।

এরপরের গন্তব্য পিয়াজ্জা ন্যাভনা, প্রাচীন কালে স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত এই চত্বরে তখন লাখো দর্শনার্থীর ভিড়, এর মাঝে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হরেক জাতের দোকানীরা, এর মাঝে ভাল করে খুঁটিয়ে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব, তাই মূলত দেখা হল এই চত্বরের মূল আকর্ষণ বিখ্যাত রেনেসাঁ শিল্পী ভ্যাটিকানের বরপুত্র বার্নিনির চারনদীর ঝরনা। বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গের চারদিকে প্রবাহিত চার নদীর প্রতীক হিসেবে পৃথিবীর চারটি মহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত চার নদী দানিয়ূব, গঙ্গা, নীলনদ ও প্লেটের প্রতীকি ভাস্কর্য। মজার ব্যপার হচ্ছে এই অনন্যসাধারণ ঝরনাটি নির্মাণের সময় নীলনদের উৎস মানুষের অজানা ছিল তাই এর মাথাটি যেন বস্ত্রখণ্ড দিয়ে আবৃত।

ঝর্নাস্তম্ভের ঠিক মাঝখানে সগৌরবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাড়িয়ে আছে সুউচ্চ অবেলিস্ক স্তম্ভ। চার নদীর ঝর্না ছাড়াও এই চত্বরেই আছে একাধিক নয়নাভিরাম ঝর্না যার স্থপতিও বার্নিনি।

চারপাশে প্রাচীন সব আবাসস্থলের ছড়াছড়ি। কিন্তু এই ভিড় এড়িয়ে রওনা হলাম খোদ রোমের সবচেয়ে প্রাচীন পুরাকীর্তির দিকে, যার নাম প্যানথেওন!

২০০০ বছরের অধিক বয়সী এত চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত ভবন রোমেও আর নেই। প্রাচীন রোমান দেব-দেবীদের আরাধনার জন্য স্থাপিত এই অসাধারণ এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবনটি ৬০৯ সালে পরিণত হয় খ্রিস্ট ধর্মের গির্জাতে, এভাবেই তা রক্ষা পায় ধর্মান্ধদের হাতে ধ্বংস হবার পরিণতি থেকে। এ এক অদ্ভুত অদেখা ভুবন, মূল দরজা পার হতেই সময় যেন পিছিয়ে গেল হাজার হাজার বছর, সেই একেই আলোআঁধারময় সুপ্রাচীন ইতিহাস বাতাসে মিশে তৈরি করেছে এক আলেখ্য আবহ। ১৪২ ফিট পরিধি আর উচ্চতার সুবিশাল সেই গম্বুজের ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি মাত্র গোলাকৃতি ছিদ্র, যা সত্যিকার অর্থে সুবিশাল প্যানথেওনে সূর্যের আলো প্রবেশের একমাত্র পথ, আর সূর্যদেবের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই রশ্মি বিভিন্ন অংশে পড়ে তৈরি করে অপার্থিব সব রূপ, রেখা, রঙ।

রেনেসাঁ যুগ থেকে প্যানথেওন ব্যবহৃত হত থাকে সমাধিস্থল হিসেবে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সমাধিটি ভুবনবিখ্যাত শিল্পী রাফায়েলের। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা স্থপতি নকশাবিদ ও বিশ্বের প্রথমদিককার একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। ১৫২০সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই এই ভুবনের মায়াত্যাগ করেন মরণশীল ঈশ্বর রাফায়েল।
প্যানথেওন বর্তমানে রোম মহানগরীর সবচেয়ে গভীর অংশে অবস্থান করছে, বলা হয় এর চারপাশে মাটির স্তর দেখলেই বোঝা যায় গত দুই হাজার বছরে কি পরিমাণ মাটি জমেছে এই অঞ্চলে। যে কারণে একসময় প্যানথেওন রোমের শীর্ষে অবস্থান করলেও আজ তা সী লেভেল থেকে মাত্র ৪৫ ফিট উঁচুতে অবস্থান করছে, অর্থাৎ রোমে বন্যা দেখা দিলে সবার আগে অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির সম্মুখীন হবে বিশ্বসম্পদ প্যানথেওন। মনোমুগ্ধকর এই স্থাপত্য থেকে বেরোতেই দেখি সূর্য প্রায় পশ্চিমের কোলে, আরামদায়ক এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশের বাতাসে আর আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনা দিলাম সেদিনের শেষ গন্তব্যস্থল ত্রেভির ঝর্নার দিকে। বলা হয়ে থাকে ত্রেভি ঝর্না দেখে তাতে পয়সা নিক্ষেপ করে কোন আকাঙ্খা ব্যক্ত না করলে নাকি রোম ভ্রমণ কোন ভাবেই সম্পূর্ণ হয় না!

ঠিক সূর্যাস্তের মুহূর্তে আমার উপস্থিতি রোমের সবচেয়ে বড় ঝর্না ত্রেভির সামনে, ৮৫ ফিট দীর্ঘ আর ৬৫ ফিট প্রসস্থ ঝর্নাতে অসংখ্য মর্মর ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি কিন্তু এর শাসনকর্তা ঠিক ঝর্নার দেয়ালের কেন্দ্রস্থলে দাড়িয়ে থাকা সাগর দেবতা নেপচুন, তার রথের উপরে বিশ্বশাসনের ভঙ্গিমায়।

তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত এই বিশাল ঝর্নাটির নির্মাণ কাজ প্রাক রেনেসাঁ যুগে শুরু হলেও তা শেষ হয় ১৭৬২ সালে। রোমে দর্শনার্থীরা সবাই-ই ত্রেভি ঝর্নার জলের কিনারে উল্টো হয়ে পয়সা ছুড়ে মারেন, এর অর্থ তারা আবার কোন না কোন সময়ে রোমে প্রত্যাবর্তন করবেন। এক সমীক্ষায় জানা গেছে এতে প্রতিদিন বাংলাদেশী টাকায় তিন লক্ষ টাকার উপরে পাওয়া যায়, যা রোমে দুঃস্থদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য সংস্থায় যায়। চারিদিকে লাখো পর্যটকের ভিড়, সবাই চাইছে মুদ্রা ঝর্নার জলে নিক্ষেপ করে নিজের ভালবাসার রোমে বারংবার ফিরে আসা নিশ্চিত করতে। সূর্যাস্তের শেষ মুহূর্তে রোমের প্রতি, এর শিল্পের প্রতি, এর কারিগরির প্রতি, এর অধিবাসীদের প্রতি একবুক অব্যক্ত ভালবাসা নিয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম সেই দলে।।

স্বপ্ননগরী রোমে পা দিলাম আমরা এক সন্ধ্যায়, আমরা বলে আমি আর ইতালির বোলগনা বিশ্ব- বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মণি ভাই। বেশী আঁধার হয়ে আসায় আর কোথাও ঘোরাঘুরি না করে রেলস্টেশনের কাছেই এক হোটেলে আস্তানা গাড়লাম সেই রাতের মত, তবে হোটেল রিসেপ্সনিস্টের কাছে থেকে জেনে নিতে ভুললাম না কিভাবে পরদিন প্রথম গন্তব্য বিশ্বের বিস্ময় রোমের কলোসিয়ামে পৌঁছাব যা আমাদের হোটেল থেকে পদব্রজে মাত্র মিনিট দশেকের পথ।
পরদিন সূর্যিমামা গগনের কোনে উকি দেওয়ার পরপরই আমরা ম্যাপ হাতে চললাম কলোসিয়ামের পানে।এই গলি, সেই গলি, এই রাস্তা, সেই রাস্তা পার হয়ে অবশেষে এক মোড় ঘুরতেই নজরে আসল চিরচেনা কলোসিয়ামের বিশাল অবয়ব, ইতিহাস যেন থমকে গেছে এইখানে।

এই সাতসকালেও দেখি আমাদের আগে বেশ কিছু্ দর্শনার্থীর ভিড়, বিশাল লাইন হয়ে গেছে প্রায় ২০০০ বছর আগে নির্মিত তৎকালীন এই অ্যারেনা বা স্টেডিয়ামে ঢোকার জন্য। উল্লেখ্য, এইটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রোমান অ্যাম্ফিথিয়েটার। ৫০,০০০ মানুষের ধারনক্ষমতা সম্পন্ন এই অ্যারেনা মূলত ব্যবহৃত হত লোকসমাগম, রাজকীয় ভাষণ, নাটক আর বিনোদনের নানা আসরের জন্য, বিশেষ করে ইতিহাস কুখ্যাত গ্ল্যাডিয়েটর মল্লযুদ্ধের কারণে। বিশ্বের মধ্যযুগের সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম এই রোমান স্থাপত্য আসলেই মনে অপার বিস্ময়ের উদ্রেক করে, আজ ২০০০ বছর পরেও রোদ-বৃষ্টি-ঝড়সহ প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্প আর পাথরচোরদের দৌরাত্ন উপেক্ষা করে কালের করাল গ্রাসের নানা সাক্ষী আপন শরীরে নিয়ে আমাদের সামনে তা গর্বভরে দাড়িয়ে থাকে অতীত ও আধুনিক যুগের মিলনকেন্দ্র হয়ে। অবশেষে ভিতরে ঢোকার সৌভাগ্য হয় আমাদের সেই বিস্ময়ের বিস্ময়ে, সারি সারি গ্যালারী, কুলীন আর সাধারণ জনগণের জন্য পৃথক বসার ব্যবস্থা আর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সিজার আর সিনেটরদের জন্য আলাদা আলাদা বিলাসবহুল কক্ষ।
অ্যারেনার কেন্দ্রস্থলে প্রায় গোলাকৃতির এক মাঠ থাকার কথা যেমনটা আমরা সাধারণত চলচ্চিত্রে আর চিত্রকর্মে দেখে থাকি কিন্তু সময়ের ভারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কলোসিয়ামটির পাটাতন ভেঙ্গে পড়েছে অনেক অনেক আগেই, সেই ভঙ্গুর পরিবর্তনযোগ্য পাটাতনেই মল্লযুদ্ধ হত গ্ল্যাডিয়েটর আর নানা বুনো পশুদের, সেই সাথে যুদ্ধ অনুযায়ী পট পরিবর্তন করা হত প্রায়শই, কখনো মরুভূমি, কখনো জঙ্গল, কখনো বা জলজগৎ। তবে পাটাতনটি ভেঙ্গে পড়ায় তার নিচের স্থাপত্যে আমাদের দৃষ্টি পড়ে অবধারিত ভাবেই, জানা যায় সেখানকার সারি সারি ক্ষুদে কামরাগুলো ব্যবহার হত পশুর খাঁচা, খাদ্যের গুদাম আর গ্ল্যাডিয়েটরদের বিশ্রামাগার ও শরীরচর্চার ক্ষেত্র হিসেবে।

আর গ্যালারীগুলো ঘুরে ঘুরে যেন সব এসে এক জায়গাতেই মিলিত হয়েছে, এই আশ্চর্যকর স্থাপত্য এমনভাবে তৈরি যেন মাঝের মাঠটাতে সৃষ্টি হওয়া প্রতিটি শব্দ সবচেয়ে উঁচুতে বসে থাকা দর্শকের কানে যেন নিখুঁত ভাবে পৌছায়! প্রাচীন সেই সরু সরু অলি গলিতে মুগ্ধ হয়ে ঘুরতে থাকি আমরা, সূর্যের তেজালো রশ্মি এসে পড়েছে কলোসিয়েমের অর্ধেকে, অবাক হয়ে ভাবছি যে রোমানদের বলা হয় আধুনিক সভ্যতার জন্মদাতা, যারা বিশ্বকে এনে দিল প্রথমবারের মত গণতন্ত্রের স্বাদ, তারা কিভাবে পারত এই রক্তপাতময় বিনোদনকে উপভোগ করতে? একদল মানুষ যথেচ্ছ ভাবে লড়ে যাচ্ছে প্রাণের দায়ে, অথবা বুনো বাঘ, সিংহ হামলে হামলে খাচ্ছে ক্রীতদাস বা যুদ্ধবন্দীদের, এই অমানুষিক অচিন্ত্যনীয় ঘটনাগুলোও ছিল রোমানদের কাছে নিছকই বিনোদন।

অবশেষে কয়েকঘণ্টা পরে একরকম জোর করেই কলোসিয়াম থেকে বের হয়ে আমরা রওনা দিলাম অন্য গন্তব্যের দিকে। অ্যারেনার মূল দরজার সামনেই দেখা হল একাধিক রোমান সৈন্যর সাথে, আসলে একদল শিল্পী যারা তৎকালীন রোমান সৈন্যদের পোশাক ও নকল অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে টহল দিচ্ছে, পর্যটকদের মনোরঞ্জনের এক ফন্দি, অনেকেই সাগ্রহে ছবি তুলছে তাদের সাথে।

কলোসিয়ামের অদূরেই বিশ্বখ্যাত ইতিহাসময় স্থাপত্য রোমান ফোরাম, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে যাত্রা শুরু করা সিজারের ভাষণ ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয়কাজে ব্যবহৃত এই সুরম্য স্তম্ভ ও ভবনময় এলাকাটি কালের করাল গ্রাসে হারিয়েই যেতে বসেছিল, দুইশ বছর আগেও এর অধিকাংশ স্থান ছিল দশ ফুট মাটির নিচে! ধন্যবাদ ইতালীয় প্রত্নতাত্ত্বিকদের, তাদের অপরিসীম চেষ্টা ও বিপুল অধ্যবসায়ের ফলেই আজ আমরা খানিকটা দেখতে পারছি অতীতের কোল খুঁড়ে বাহির করা এই ইতিহাসস্নাত স্থান। জানলাম জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পরে রোমান সেনাপতি মার্ক অ্যান্টনী এইখানেই দাড়িয়ে রোমানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন। কি অদ্ভুত অনুভুতি, রোমের সবখানেই ইতিহাসের এমন ছড়াছড়ি! প্রতি নিঃশ্বাসে, প্রতি পদক্ষেপেই আপনি অনুসরণ করতে পারবেন তা।


এরপরে যাত্রাপথে এসে দাড়ায় দিগন্ত আড়াল করে থমকে থাকা অতুলনীয় বিশালত্ব আর সৌন্দর্যের অধিকারী সফেদ মর্মর পাথরের ভবন ভিক্তর ইমানুয়েল মনুমেন্ট। ইতালির নানা রাজ্যকে সর্বপ্রথম এক পতাকার নিচে নিয়ে আসা অবিভিক্ত ইতালির প্রথম রাজা ভিক্তর ইমানুয়েলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২৩০ ফুট উচু ও ৪৪৩ ফুট দীর্ঘ উৎকৃষ্ট মার্বেল পাথরের এই ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৩৫ সালে। মূল সিংহদরজার সামনেই এক বেদীর উপরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত এক নাম না জানা সৈনিকের সমাধি, যা ইতালির স্বাধীনতা ও তা রক্ষার্থে প্রাণদানকারীদের প্রতীক। ভেতরে ঢোকার সুতীব্র ইচ্ছা থাকলেও দরজায় দর্শনার্থীদের ভিড় দেখে সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে এগোলাম রোমের প্রাণদানকারী নদী টিবেরের দিকে।

নদীপ্রধান দেশের মানুষ আমি। শৈশব, কৈশোর কেটেছে পদ্মাতীরের রাজশাহীতে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, কর্ণফুলী, ব্রহ্মপুত্র, নাফ, ইছামতী, ধলেশ্বরী কত অসম্ভব সুন্দর নদীগুলো আমাদের চিরসবুজ পলিমাটির দেশটা তৈরি করেছে লক্ষ হাজার বছর ধরে, তাই কোন দেশে গেলেই সেখানকার স্থানীয় নদী দেখার জন্য মন আনচান করে, হয়ত সেই নদীর তীরে ইতস্তত পথ ভুলে বেড়ানো কোন শিশুকে দেখে রোমন্থন করি নিজের শৈশব, পৃথিবীর সব নদীর জেলেকেই মনে হয় অতি আপন পদ্মাপারের জেলে। সোজা কথাই বলি- আমি নদী জমায়। বিভিন্ন চিত্রবিচিত্র নদী, তাদের বাঁক, লোকজন, জীবনযাত্রার সাথে একাত্নতা বোধ করি। এই মুহূর্তে জীবন নামের নদীর বাঁকে সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে টিবের নামের এই ইতিহাসখ্যাত নদী, যা সঞ্জীবনী অমৃত সুধা দিয়ে প্রাণ সঞ্চালন করেছে রোমান সভ্যতায়, যাকে কেন্দ্র করে দুপাশে বিকশিত হয়েছে আধুনিক সভ্যতার আঁতুড়ঘর। সেই দিকেই চললাম টিবেরের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য।
আল্পস পর্বতমালা থেকে যাত্রা শুরু করা ৪০৬ কিলোমিটার দীর্ঘ টিবের ভূমধ্যসাগরে মোহনায় বিলীন হবার আগ পর্যন্ত প্রায় আঠার হাজার বর্গকিলোমিটার ভূমি উর্বর করে চলেছে অনাদিকাল ধরে আপন স্বকীয়তায়, নিজস্ব ছন্দে কিন্তু তার প্রস্থ মাত্র কয়েকশ মিটার, স্থান বিশেষে আরো কম! ইউরোপের নদী হিসেবে তা ঠিক থাকলেও পদ্মা, মেঘনা, যমুনার দেশের মানুষের কাছে তা কিছুটা শীর্ণকায় বলেই প্রতীয়মান হলেও টিবেরের ইতিহাসখ্যাত অতীতের কারণে মানবজাতির কাছে তার আবেদন থাকে আগের মতই অটুট, অম্লান, আবেদনময়ী।

নদীর উপরে সারি সারি সেতু, প্রত্যেকটিতেই মর্মর পাথরের রেলিং আর সুদৃশ্য সব প্রমাণ আকারের ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি। এমন এক সেতুর অন্যপারে দেখলাম দুই হাজার বছরের সমৃদ্ধময় অতীত নিয়ে সগর্বে দণ্ডায়মান ক্যাসল সেন্ট অ্যাঞ্জেলো, দুর্গাকৃতির এই ভবনটি ছিল এক সময়ের বিখ্যাত রোমান সম্রাট হাইড্রিয়ানের সমাধি, পরবর্তীতে তা ব্যবহার হয় দুর্গ, কারাগার ও পোপদের বিপদকালীন সময়ের আবাসস্থল হিসেবে। বর্তমানে সেখানে প্রতিরক্ষা জাদুঘরের অবস্থান।

এমনই আরেক সারি সারি দেবদূতের ভাস্কর্য শোভিত সেতুর অন্য প্রান্তে চোখে পড়ল আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টারত এক অবেলিস্ক স্তম্ভ, তারপর বিশালাকার এক গম্বুজ ও সুরম্যপ্রাসাদ। বুঝলাম চেয়ে আছি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম দেশ ভ্যাটিকান সিটির পানে, রোম মহানগরীর মাঝেই যে এর অবস্থান। কিন্তু সে অন্য সময় দেখব এই চিন্তা করেই টিবেরের প্রতি নীরব শ্রদ্ধা জানিয়ে চললাম পিয়াজ্জা ন্যাভনার উদ্দেশ্যে।
রোমের একমাথা থেকে আরেক মাথা পায়ে দলতে দলতে ক্ষিদে পেয়েছে বেশ, কাছে পিঠেই এক রেস্তরা দেখে ঢুকে পড়লাম পেটপূজোর আশায়। ইতালি ভোজনরসিকদের প্রিয় দেশ, রসনাতৃপ্তকারী রকমারি মজাদার খাবারের জন্ম ও বিস্তার এই দেশে। মুখে জল আনা পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি আর কত নাম বলব! সেই সাথে আছে শত শত বর্ণ, গন্ধ, স্বাদের চীজ। মনপ্রাণ উদাস করা এক ধরনের স্প্যাগেটিই খেলাম ভূমধ্যসাগরের খাঁটি জলপাই তেল দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে। সেই সাথে প্রচুর দুধ চিনি দেওয়া বিশেষ ধরনের কফি- ক্যাফে দ্য লাত্তে। রেস্তরাটি অত্যন্ত সুরুচিপূর্ণ ভাবে সাজানো, আধুনিকতার সাথে নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে বিশ্বনন্দিত ক্ল্যাসিক সব চলচ্চিত্রের কিছু আলোকচিত্র, সবই সাদা কালো। এর মাঝে আবার বিশেষভাবে সাজানো রোমে শুটিং করা সিনেমাগুলো যার মধ্যমণি হয়ে আছে প্রিয়মুখ অড্রে হেপবার্ন আর গ্রেগ্ররী পেক অভিনীত বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক সিনেমা রোমান হলিডে।

এরপরের গন্তব্য পিয়াজ্জা ন্যাভনা, প্রাচীন কালে স্টেডিয়াম হিসেবে ব্যবহৃত এই চত্বরে তখন লাখো দর্শনার্থীর ভিড়, এর মাঝে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে হরেক জাতের দোকানীরা, এর মাঝে ভাল করে খুঁটিয়ে কিছু দেখা প্রায় অসম্ভব, তাই মূলত দেখা হল এই চত্বরের মূল আকর্ষণ বিখ্যাত রেনেসাঁ শিল্পী ভ্যাটিকানের বরপুত্র বার্নিনির চারনদীর ঝরনা। বাইবেলে বর্ণিত স্বর্গের চারদিকে প্রবাহিত চার নদীর প্রতীক হিসেবে পৃথিবীর চারটি মহাদেশের অন্যতম বিখ্যাত চার নদী দানিয়ূব, গঙ্গা, নীলনদ ও প্লেটের প্রতীকি ভাস্কর্য। মজার ব্যপার হচ্ছে এই অনন্যসাধারণ ঝরনাটি নির্মাণের সময় নীলনদের উৎস মানুষের অজানা ছিল তাই এর মাথাটি যেন বস্ত্রখণ্ড দিয়ে আবৃত।

ঝর্নাস্তম্ভের ঠিক মাঝখানে সগৌরবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাড়িয়ে আছে সুউচ্চ অবেলিস্ক স্তম্ভ। চার নদীর ঝর্না ছাড়াও এই চত্বরেই আছে একাধিক নয়নাভিরাম ঝর্না যার স্থপতিও বার্নিনি।

চারপাশে প্রাচীন সব আবাসস্থলের ছড়াছড়ি। কিন্তু এই ভিড় এড়িয়ে রওনা হলাম খোদ রোমের সবচেয়ে প্রাচীন পুরাকীর্তির দিকে, যার নাম প্যানথেওন!

২০০০ বছরের অধিক বয়সী এত চমৎকার ভাবে সংরক্ষিত ভবন রোমেও আর নেই। প্রাচীন রোমান দেব-দেবীদের আরাধনার জন্য স্থাপিত এই অসাধারণ এক গম্বুজবিশিষ্ট ভবনটি ৬০৯ সালে পরিণত হয় খ্রিস্ট ধর্মের গির্জাতে, এভাবেই তা রক্ষা পায় ধর্মান্ধদের হাতে ধ্বংস হবার পরিণতি থেকে। এ এক অদ্ভুত অদেখা ভুবন, মূল দরজা পার হতেই সময় যেন পিছিয়ে গেল হাজার হাজার বছর, সেই একেই আলোআঁধারময় সুপ্রাচীন ইতিহাস বাতাসে মিশে তৈরি করেছে এক আলেখ্য আবহ। ১৪২ ফিট পরিধি আর উচ্চতার সুবিশাল সেই গম্বুজের ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি মাত্র গোলাকৃতি ছিদ্র, যা সত্যিকার অর্থে সুবিশাল প্যানথেওনে সূর্যের আলো প্রবেশের একমাত্র পথ, আর সূর্যদেবের অবস্থান পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই রশ্মি বিভিন্ন অংশে পড়ে তৈরি করে অপার্থিব সব রূপ, রেখা, রঙ।

রেনেসাঁ যুগ থেকে প্যানথেওন ব্যবহৃত হত থাকে সমাধিস্থল হিসেবে, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সমাধিটি ভুবনবিখ্যাত শিল্পী রাফায়েলের। উল্লেখ্য, তিনি ছিলেন সেই সময়ের অন্যতম সেরা স্থপতি নকশাবিদ ও বিশ্বের প্রথমদিককার একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ। ১৫২০সালে মাত্র ৩৭ বছর বয়সেই এই ভুবনের মায়াত্যাগ করেন মরণশীল ঈশ্বর রাফায়েল।
প্যানথেওন বর্তমানে রোম মহানগরীর সবচেয়ে গভীর অংশে অবস্থান করছে, বলা হয় এর চারপাশে মাটির স্তর দেখলেই বোঝা যায় গত দুই হাজার বছরে কি পরিমাণ মাটি জমেছে এই অঞ্চলে। যে কারণে একসময় প্যানথেওন রোমের শীর্ষে অবস্থান করলেও আজ তা সী লেভেল থেকে মাত্র ৪৫ ফিট উঁচুতে অবস্থান করছে, অর্থাৎ রোমে বন্যা দেখা দিলে সবার আগে অস্তিত্ব নিয়ে হুমকির সম্মুখীন হবে বিশ্বসম্পদ প্যানথেওন। মনোমুগ্ধকর এই স্থাপত্য থেকে বেরোতেই দেখি সূর্য প্রায় পশ্চিমের কোলে, আরামদায়ক এক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশের বাতাসে আর আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে রওনা দিলাম সেদিনের শেষ গন্তব্যস্থল ত্রেভির ঝর্নার দিকে। বলা হয়ে থাকে ত্রেভি ঝর্না দেখে তাতে পয়সা নিক্ষেপ করে কোন আকাঙ্খা ব্যক্ত না করলে নাকি রোম ভ্রমণ কোন ভাবেই সম্পূর্ণ হয় না!

ঠিক সূর্যাস্তের মুহূর্তে আমার উপস্থিতি রোমের সবচেয়ে বড় ঝর্না ত্রেভির সামনে, ৮৫ ফিট দীর্ঘ আর ৬৫ ফিট প্রসস্থ ঝর্নাতে অসংখ্য মর্মর ভাস্কর্যের ছড়াছড়ি কিন্তু এর শাসনকর্তা ঠিক ঝর্নার দেয়ালের কেন্দ্রস্থলে দাড়িয়ে থাকা সাগর দেবতা নেপচুন, তার রথের উপরে বিশ্বশাসনের ভঙ্গিমায়।

তিন রাস্তার মোড়ে অবস্থিত এই বিশাল ঝর্নাটির নির্মাণ কাজ প্রাক রেনেসাঁ যুগে শুরু হলেও তা শেষ হয় ১৭৬২ সালে। রোমে দর্শনার্থীরা সবাই-ই ত্রেভি ঝর্নার জলের কিনারে উল্টো হয়ে পয়সা ছুড়ে মারেন, এর অর্থ তারা আবার কোন না কোন সময়ে রোমে প্রত্যাবর্তন করবেন। এক সমীক্ষায় জানা গেছে এতে প্রতিদিন বাংলাদেশী টাকায় তিন লক্ষ টাকার উপরে পাওয়া যায়, যা রোমে দুঃস্থদের জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি দাতব্য সংস্থায় যায়। চারিদিকে লাখো পর্যটকের ভিড়, সবাই চাইছে মুদ্রা ঝর্নার জলে নিক্ষেপ করে নিজের ভালবাসার রোমে বারংবার ফিরে আসা নিশ্চিত করতে। সূর্যাস্তের শেষ মুহূর্তে রোমের প্রতি, এর শিল্পের প্রতি, এর কারিগরির প্রতি, এর অধিবাসীদের প্রতি একবুক অব্যক্ত ভালবাসা নিয়ে আমিও ভিড়ে গেলাম সেই দলে।।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন