
আমার ব্যালকনি থেকে নীল
আধুনিক ইজিপ্ট, বিশেষ করে কায়রোর জীবনযাত্রা যেন বৈপরীত্য আর
বৈচিত্র্যের এক বিচিত্র প্রদর্শণী যেখানে দুর্দমনীয় হিমবাহের মত ধেয়ে আসা
ট্রাফিক, গাড়ির হর্নের চিৎকার আর সহস্র মিনার থেকে ভেসে আসা আযানের ধ্বণি
প্রতিমুহূর্তে ঘোষনা করে যাচ্ছে এক ব্যাতিব্যস্ত বর্তমান আর এক অতিজাগতিক
ঐতিহ্য।স্কাইস্ক্রেপার, হাইওয়ে, সাবওয়ে, ফ্লাইওভার, ওভারপাস, আন্ডারপাস,
হোটেল, ক্যাবারে, বার, নাইটক্লাব, অর্ধনগ্ন বেলি ড্যান্সার, বিজ্ঞাপনের
বিলবোর্ড, অপেরা হাউস, সিনেপ্লেক্স, বিলিওনিয়ার পল্লী, রক্ষিতা পল্লী,
বাগানবাড়ি, পশ্চিমা পোশাকের জয়জয়কার, নীলনদে রঙবেরঙের নৌকায় তরুন-তরুনীদের
হুল্লোড়, স্টিয়ারিং-এ ড্রামের বোল তুলে উচ্চস্বরে পশ্চিমা গান বাজিয়ে
ফোর-হুইল-ড্রাইভ হাঁকানো জিন্স-টিশার্ট পরা চক্রা-বক্রা তরুনী বা
দলবদ্ধভাবে হার্লি ডেভিডসন/মোটরবাইক হাঁকানো তরুনের দল আধুনিক কায়রোর
জীবনযাত্রার এক অনন্য বিচিত্র নকশায় মিলেমিশে যায় বোরখা-আবায়া পরিহিত
প্রাচীনপন্থী নরনারী, পুরনো কায়রো বা ব্রিজের তলায় থাকা দরিদ্র মানুষ,
পিরামিড-স্ফিংস আর সভ্যতার প্রাচীণতম নিদর্শনসমূহ, গাজী সালাউদ্দিনের দুর্গ
আর হযরত উমরের মসজিদ সহ হাজারো নবীন-প্রাচীণ মিনার-মসজিদ আর মুসল্লীর দল,
আল-আজহার, মৌলবাদী মুসলিম ব্রাদারহুড, প্রাচীণ কপ্টিক গীর্জা, ইহুদী
সিনাগগ, গোলকধাঁধাময় মধ্যযুগীয় বাজার আর ভেসে আসা
সরমা-কাবাব-কোপ্তা-শীষা-গাধা-খচ্চর আর গবাদি পশুর সম্মিলিত সুরভির মৌতাতের
সাথে।
কায়রো

সেন্ট এ্যান্থনির মঠ: পৃথিবীর প্রাচীণতম খৃষ্টান আশ্রম

কায়রো তারুন্য

কায়রো তারুন্য
আজকের ইজিপ্ট সংসদীয় প্রজাতন্ত্র যেখানে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সরকার
প্রধান। বিচার ব্যবস্থার ভিত্তি ব্রিটিশ কমন ল আর ইসলামিক নৈতিক/পারিবারিক
আইন। তবে প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারক সাহেব মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি – প্রায়
যেন একবিংশ শতাব্দীর এক ফারাও। তার বিশাল সব পোস্টার কায়রোর বহু জায়গাতেই
দেখা যায়। সেই সাথে দেখা যায় কোকা কোলা, বিভিন্ন সিগারেট ব্র্যান্ড আর দামী
পশ্চিমা পন্যের বিলবোর্ড। সেসবের নীচে আবার আর্মার্ড শীল্ডের আড়ালে হেভি
মেশিন গান নিয়ে মোড়ে মোড়ে প্যারা-মিলিটারি ফোর্সের নিঃশব্দ চৌকি। এ দিক
থেকে অন্তত ইজিপ্ট মনে হয় হাজার বছরেও পাল্টায়নি – শাসন, ব্যাসন আর
বিজ্ঞাপন। তখনো ছিল, এখনো আছে। তখন মাথার উপরে ছিলেন ফারাও, এখন
প্রেসিডেন্ট। প্রায় একই ব্যাপার।
ফারাও তুতানখামেন

ফারাও হোসনি মুবারক
কেউ কেউ বলে ‘পুলিশ স্টেট’। তবে সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এর
প্রভাব কতটুকু তা আমার মত একজন বসন্তের কোকিল বিদেশীর পক্ষে বাইরে থেকে
দেখে বুঝে ওঠা কঠিন। এমনিতে আধুনিক কায়রোর মানুষের মধ্যে উপর থেকে দেখে আমি
সহজতা ও প্রানবন্ততা এই উপমহাদেশের মানুষের চেয়ে বরং বেশি অনুভব করেছি।
অনেক সময় ভাষা না জানলেও চলে – চোখ আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজের দিকে তাকিয়েও অনেক
কিছু বোঝা যায়। তবে ভুলও হতে পারে হয়তো।ইসলাম প্রায় ৯০%-এর ধর্ম। বেশ কয়েকটা জাতীয় ছুটির দিন ইসলাম-ভিত্তিক, তবে খৃষ্টান ও ইহুদী-ধর্মও সরকারিভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত। খৃষ্টান ও ফারাওনিক উৎসজাত জাতীয় ছুটির দিনও আছে, অনেকটা আমাদের নববর্ষের মত। মিশর অন্যান্য রক্ষনশীল আরব দেশগুলির তুলনায় নিশ্চিত ভাবেই অনেক লিবারেল, কোন কোন দিক থেকে এমনকি ৩য় বিশ্বের অন্য কিছু প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক দেশের থেকেও আপাতদৃষ্টে লিবারেল মনে হতে পারে। তবে এটা অবশ্যই রাজনৈতিক ভাবে প্রকৃত গণতান্ত্রিক দেশ নয়, এমনকি বাংলাদেশের তুলনাতেও না, যদিও সাংস্কৃতিক ভাবে কোন কোন বিষয়ে হঠাৎ করে লিবারেল মনে হতে পারে। তবে ইদানিং বেশ কয়েক বছর ধরে রক্ষণশীলতা বাড়ছে আবার।

গার্লি কায়রো। নীচের ছবি দ্রষ্টব্য।

গার্লি কায়রো। উপরের ছবি দ্রষ্টব্য।
অন্যদিকে ইজিপ্ট, উপমহাদেশের কোন কোন দেশের তুলনায় অনেক কম ক্যাওটিক;
অর্গানাইজড, সুশৃঙ্খল, সাধারনভাবে উন্নততর জীবনযাত্রার মানসম্পন্ন।তবে ধনী
আরব দেশগুলির তুলনায় অনেক গরীব অবশ্যই।গরীব দেশই এটা। অথচ আমি যখন ইজিপ্টে,
শুনেছিলাম এক ইজিপশীয় টাকায় নাকি ১৭ পিস রুটি (অনেকটা নানের মত) পাওয়া
যায়। এটা সত্যি হলে, দেশের সবচেয়ে গরীব লোকটাও না খেয়ে থাকে না (যা-ই খাক,
বোধহয় পেট ভরেই খায়), পার্শ্ববর্তী সৌদির মত বিলাসিতা বা নিকটবর্তী আফ্রিকা
বা উপমহাদেশের কোন কোন দেশের দরিদ্রদের মত আত্নহত্যার সীমান্তবর্তী নয়।
নিম্ন-মধ্যবিত্তদের ইহকালে গাড়ি-বাড়ি থাকে (অন্তত বাংলাদেশ এ্যাম্বেসীর
ইজিপ্সহীয় রিসেপশনিস্টকে নিজের গাড়ি চালিয়ে অফিসে আসতে দেখেছি), আর পরকালের
জন্য কবরস্থানে আগে থেকে কবর রিজার্ভ করা থাকে।অন্য এক শহরে যাওয়ার সময় এক
ড্রাইভার আমাকে মরুভূমির মধ্যে দূরে একটা শহর দেখিয়েছিল যেখানে নাকি ওর
কবর রিজার্ভ আছে। পুরো শহরটা প্রাচীণ মিশরীয় অলঙ্করনে বানানো ছোট ছোট একতলা
কেবিনের সারি যেন।সারির মাঝখান দিয়ে সরলরৈখিক পাকা রাস্তা বা গলি।
স্ট্রীটল্যাম্প ছিল কিনা মনে নাই – চলার পথে একটুখানি দেখা। কেবিনগুলোকে
দূর থেকে পিচ্চি একেকটা প্রাসাদ মনে হচ্ছিল সুন্দর অলঙ্করনের জন্য।
নির্জন, নীরব, দারুন সাজানো-গোছানো শহর। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কই
কবরস্থানটা কোথায় ? আর শহরটা এত নির্জন কেন ? তার সহাস্য উত্তর – পুরো
শহরটাই তো রিজার্ভ কবরস্থান। আর ওরই মধ্যে একটা কেবিন তার অগ্রিম বুক করা
সমাধিসৌধ ! আদি ও অকৃত্রিম ফারাওনিক স্টাইল। কি বলবো, আমার মুখ দিয়ে আর
একটা কথাও বেরুল না এরপর অনেকক্ষন। মনে পড়ে গেল মাস দু’য়েক আগে মা’কে দাফন
করেছি বাবার কবরের মধ্যে।
পুরান কায়রো

নতুন কায়রো
মধ্যবিত্তদের অনেকেরই বিভিন্ন রিসর্ট শহরে নিজস্ব হলিডে/ভ্যাকেশন হোম
থাকে। রেড-সী আর মেডিটের্যানিয়ানে এমন ভিলা ও কটেজে গিয়েছি। উচ্চবিত্তদের
কথা বাদই দিলাম। পৃথিবীর সর্বপ্রথম পিরামিড ও প্রাচীণতম স্থাপনা – প্রায়
পাঁচ হাজার বছর পুরনো সাক্কারা নেক্রোপলিসের বিখ্যাত স্টেপ-পিরামিডের প্রায়-পাদদেশের
অসামান্য এগজটিক-সিনিক লোকেশনে অবস্থিত বিশাল বাগানবাড়িতে বিলিওনিয়ারের
ব্যক্তিগত পোলো-গ্রাউন্ডে পাকিস্তান থেকে প্লেনে করে নিজ খরচে উড়িয়ে আনা
ঘোড়া-টোড়া-কোচ-খেলোয়াড় সমেত আস্ত একটা প্রাইভেট পোলো-দলের সাথে (যার
ক্যাপ্টেন সাময়িকভাবে আবার ঐ বিলিওনার নিজেই হলেন) জর্ডান থেকে নিমন্ত্রিত ঐ
দেশের এক বন্ধু-যুবরাজের নেতৃত্বে আসা আরেকটা পোলো দলের সাথে প্রাইভেট
ফ্রেন্ডলি ম্যাচ দেখলাম।বিভিন্ন দেশ থেকে উড়িয়ে আনা ১ম সারির শেফদের রান্না
মহার্ঘ খাদ্যবস্তুতে ভারাক্রান্ত বাগানে সাজানো সিকিমাইল লম্বা টেবিল-সারি
থেকে খাবার নিয়ে খেতে খেতে। দামী রঙীণ পানীয়ের কথা বাদই দিলাম। অভুতপূর্ব,
অপূর্ব লোকেশন এবং অভিজ্ঞতা। আগে পোলো দেখিনি – তাও আবার রাজা-রাজড়ার খেলা
যখন রাজা-রাজড়ারাই খেলছেন ! সামনে নীল আকাশের নীচে বিশাল সবুজ
পোলো-গ্রাউন্ডে দলে দলে স্বাস্থ্যবান ঘোড়ার দলের যুদ্ধ, প্রতিদ্বন্দ্বীতা,
চিঁহি, ফোঁসফোঁসানি আর তীব্র এ্যকশন আর আরো বেশ দূরে নিস্পাদপ মরুভূমির
উঁচু ভূমিতে বিশ্বের প্রাচীণতম ধবল পিরামিডের রাজসিক ধ্যানমগ্ন স্তব্ধতা।
জীবন আর মৃত্যু, আধুনিকতা আর প্রাচীণত্ব, মৃত রাজসিকতার ধ্যানমৌন ছায়াতলে
জীবন্ত রাজসিকতার এ্যাকশন-প্যাক্ড স্টাইলের দাবড়ানি, মরুভূমি আর শ্যামলিমা
– সব পাশাপাশি। এক অদ্ভুত সৌন্দর্য এবং প্রায় অতিন্দ্রীয় কন্ট্রাস্ট।কায়রোর বাইরে মরুভূমি ভেদ করে যাওয়া রাস্তার ধারে দরিদ্র গ্রাম্য মিশরীয়দেরও দেখেছি। মরুভূমির শুকনো খটখটে বালুসর্বস্ব আবহাওয়ায়, শতবর্ষ তেল-পানি না পড়া জটাজুট মরচেপড়া লোহার-তারের ছোবড়ার মত চুল মাথায় নিয়ে বোঝা-বহনকারী জীর্ণশীর্ণ গ্রাম্য-বালিকাদের দেখে বিলিওনিয়ারের চর্ব্যচোষ্যলেহ্যপেয় আর মাখনমসৃন সুবেশ-সুবেশিনী অতিথিদের কথা মনে পড়ে যায়। কোন অর্ধচেতন অপরাধবোধ ? নাহ্! মানুষে-মানুষে পার্থক্যের মাত্রা আর বাস্তবতা ততদিনে ব্যক্তিগত ভাবেই উপলব্ধি করছি। পিরামিডগুলি দেখতে দেখতে তখন সদ্য প্রিয়জন-বিয়োগজনিত সন্তপ্ত হৃদয়ে কিছু হাস্যকর, কোঁকড়ানো-কাঠকয়লার মত ফসিলে পরিণত হওয়া এককালের ক্ষমতাবান খুনিদের গগনভেদী অহমের সহস্র-বৎসরস্থায়ী আকাশছোঁয়া আত্ন-বিজ্ঞাপনের অসভ্যতার বিপরীতে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সহৃদয় আম-মানুষের (নিজের প্রিয়জনসহ) নিরবধিকাল ধরে নিশ্চিহ্ন চূড়ান্ত অবলুপ্তি আর বিস্মৃতির নির্মম বাস্তবতা বুকের ভেতর গজালের মতই সেঁধিয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন শোক বা ভালোবাসার ক্ষমতা নেই এই বাস্তবতা বদলায়। কেউ খামাখাই সহস্র বছরকালের দুরত্ব থেকেও মুখে ঝামা ঘষে, মাথায় বাড়ি মেরে জানিয়ে দিবে তার অস্তিত্ব আর অস্তিত্বের প্রাবল্য, আর কেউ (বাকি সবাই) নিঃশেষে বাতাসে মিলিয়ে যাবে তার জীবনভর প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-মায়া-মমতা- আর সমস্ত প্রাণোত্তাপ নিয়ে। যেন কোনদিন ছিলই না ! পিরামিডগুলির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রথম প্রথম এগুলিই ভাবতাম খালি। জানি না আর কোন পিরামিড-দর্শনার্থীর এরকম অনুভূতি হয়েছে কিনা কখনো, তবে এই-ই হচ্ছে আমার প্রথম পিরামিড-অভিজ্ঞতা।

খাফ-রা’র পিরামিড: গিজা, কায়রো

ফারাও ২য় র্যামসেস
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/36654
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন