২০ নভে, ২০১১

মার্কিন মুল্লুকে-৭: ভাষা

আমাদের ছোটবেলাতে হিন্দি ভাষার অত্যাচার এতো প্রবল ছিল না। ডিশ বলতে মানুষজন থালাবাটিই বুঝতো, ওটা দিয়ে খাবার আসতো – খবর নয়। টিভির অনুষ্ঠান ধরা পড়ত ছাদের এন্টেনাতে, কেবল দিয়ে কেবল বিদুৎতের চলাফেরা ছিল। আমাদের একমাত্র চ্যানেল বিটিভি যেই অনুষ্ঠান গেলাতো আমরা বিনাবাক্যব্যয়ে সেটাই গিলতাম এবং সেটা নিয়েই আলোচনা করতাম। এই কারনেই স্কুলের বন্ধু-বান্ধবরা সব্বাই একই ওয়েভলেংথেই কথাবার্তা বলতো। হিন্দি ছবি দেখার একমাত্র উপায় ছিল ভিসিআর – সেই মহার্ঘ্য বস্তু আমাদের চেনাশোনা খুব বেশি লোকের ছিল না।

এমনি এক সময়ে ভারতের টিভি চ্যানেল দূরদর্শন আগরতলাতে একটা সম্প্রচার কেন্দ্র স্থাপনা করলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য নিশ্চয় ছিল আগরতলার মানুষের কাছে ভারতমাতার বাণী পৌঁছানো। সমস্যা হচ্ছে আকাশবাণী সবদিকেই ডানা মেলে – সেই দূরের দর্শন ঢাকা শহর পর্যন্ত অনায়াসে পৌঁছে গেল। বিনাপয়সার বিটিভি ছাড়াও আরেকটা টিভি চ্যানেল দেখা যাচ্ছে – এই খবরে সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়ল।
ঢাকা শহরের মানুষ হুজুগে বিশ্বাস করে। বাসার এন্টেনা উঁচু করলে দূরদর্শন দেখা যাবে, এই ভাবনায় এন্টেনাগুলো সব আকাশমুখি হলো। সেই সঙ্গে এন্টেনার সাথে এলুমিনিয়ামের থালা-বাটি জুড়ে দেওয়া হলো। ঢাকা শহরের আকাশ জুড়ে শুধু থালা আর বাটি। এই ডিশ এন্টেনার আবিষ্কর্তা হিসাবে ঢাকা শহরের মানুষের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকা উচিত। আমরাও বাসায় ছাদের এন্টেনা বাঁশের মাথায় উঠালাম – ওটার সঙ্গে তরকারির একটা অব্যবহৃত থালা লাগিয়ে দেওয়া হলো। এরপরেই বিজ্ঞানের তেলেসমাতিতে সুদূর আগরতলা থেকে আগত বিদুৎচুম্বকীয় তরঙ্গ ধরা পড়লা আমাদের টিভির পর্দায়। প্রবাদ ছিল – কোথায় আগরতলা আর কোথায় চৌকির তলা – কিন্তু বিজ্ঞান সবকিছুর তলাকেই হাতের কাছে এনে দিয়েছে। আমরা এই প্রথমবারের মতো দেশি টিভি বাদ দিয়ে বিজাতীয় ভাষার অনুষ্ঠান দেখতে লাগলাম।
শুরুতেই দেখা গেল ডাবর আমলা কেশ তেল কোম্পানি নায়িকা পুনম ধীলনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। পুনমজীকে জিজ্ঞেস করা হলো তাঁর দীঘল কালো আর লম্বা “হিন্দি কেশের” রহস্য কি? পুনমজীও হাস্যজ্জ্বল মুখে ওনার “বালের” যত্নে ডাবর কেশ তেলের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বর্ণনা করছেন। বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তুই হচ্ছে এটা – “বালের” রক্ষণাবেক্ষণের পুরোটাই আমলা কেশ তেলের হাতে থাকা উচিত। ওদিকে হাজার মাইল দূরে আমরা এই বিজ্ঞাপন দেখে হাসতে হাসতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি। একদেশের বুলি যে অন্যদেশের গালি হতে পারে সেটার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেশ থেকে এক পা না ফেলেই টের পেয়ে গেলাম।
মার্কিনদেশের অফিস রুমে বসে ঢাকায় ফোনালাপ করছি। আলাপ শেষে সহকর্মী ক্রিস জিজ্ঞেস করল কথার মধ্যে এতোগুলো “ফাক” ব্যবহারের কারণটা কি, আমাকে দেখে তো একদমই অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে না। বাংলায় শব্দটা হচ্ছে ফাঁক, কিন্তু আমরা সূর্যবংশের সন্তান, চন্দ্রবিন্দুর ধার ধারি না। ক্রিস নিজেও চার অক্ষরের ওই ইংরেজি শব্দ ব্যবহারে পারঙ্গম। আমি জানালাম যে এটা বাংলাভাষার “ফাক”।
“তোমার ভাষায় ফাক শব্দের মানে কি?” ক্রিসের নির্দোষ জিজ্ঞাসা।
আমি চিন্তাভাবনা করে বেশ কিছু প্রয়োগ জানালাম। সদ্য লব্ধ জ্ঞান থেকে ক্রিস একটা যুতসই ব্যবহারিক প্রয়োগ বের করলো।
আচ্ছা তোমাদের শহরের বাসে উঠে আমি কোনো মেয়ের সিটের পাশের সামান্য ফাঁকা জায়গাতে বসার জন্য নিশ্চয় অনুরোধ করতে পারি এই বলে…ক্যান গেট অ্যা ফাক?
ক্রিস এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে যায় নি, তবে অদূর ভবিষ্যতের যদি ঢাকা শহরের বাসে কোনো মোটাসোটা সাদা লোককে আচ্ছামতো ধোলাই দিতে দেখেন তবে সেই ঘটনাটা এই ব্লগের মন্তব্যের খাতায় লিখে দিতে ভুলবেন না।
এই ধরণের ঘটনা বিরল নয়। টেক্সাস টেকে নতুন আসার পরে সহপাঠী এক মেয়ের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম তার কাছে রাবার আছে নাকি। এই দেশে কন্ডোমের ডাকনাম রাবার জানা স্বত্ত্বেও এই ভুলটা প্রায় অনিবার্য। সারাজীবন পেনসিলের দাগ রাবার দিয়ে মুছে দিয়েছি। সেই রাবার দিয়ে এই দেশের লোক অন্য কর্ম সম্পাদন করলে সেই দোষটা কি আমাকে দেওয়া উচিত? এতো বছর পরে সেই চেনা বন্ধুর নামটা পাল্টে দেব এমন করে?
মেয়েটা প্রথমে একটু ক্ষুব্ধ হলেও দ্রুত সামলে নিয়েছিল, নইলে ঢাকার বাসে ক্রিসের যেই অবস্থা হবে বলে আমি আশংকা করছি ঠিক একই পরিণতি আমার নিজেরও হতে পারতো। কিন্তু সেই সহৃদয় রমণী আমাকে রাবারের বদলে ইরেজার দিয়ে ধন্য করেছিল।
ভাষা বিভ্রাট শুধুই অনিচ্ছাকৃত তাও নয়। কখনো-সখনো এটার উপর কারও হাত থাকে না। বছর দুয়েক আগে শোনা গেল যে সামান্য পয়সাতেই বাংলাদেশে দিনরাত কথা বলার অফার নিয়ে এসেছে একটা ফোন কোম্পানী। জাতিগতভাবেই আমরা যেহেতু হুজুগে বিশ্বাস করি সেহেতু দলে দলে লোক সেই ফোন সার্ভিস নিয়েছিল। কিন্তু কোম্পানিটা একটা অসাধুতা করেছিল, “আনলিমিটেড” বলতে ওরা কয়েক হাজার মিনিট বা সেই রকম কিছু বুঝিয়েছিল। এই খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো ওরা যথাসম্ভব ছোট হরফে লিখেছিল – এই কারণে বঙ্গবাসী মানুষজনের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা।
ব্যাপারটা জানার পরে বাংলাদেশিরা যথারীতিই ক্ষুব্ধ হলেন। এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হলো। দুঃখের বিষয় ফোন কোম্পানিটার নাম ছিল লিঙ্গ। তাই এই সংক্রান্ত আলোচনাগুলো একটু ইয়ে মনে হতে পারে…
“আরে ভাই আপনার ভাবিই ওই লিঙ্গ ব্যবহার করত – মাসের শেষে বিল দেখে তো মেজাজ একদম চরমে…লিঙ্গ কেটে দিয়েছি বুঝলেন…”
সংক্ষুব্ধ মানুষেরা আর দেরি করেননি, সবাই যেমন দলবেঁধে নিয়েছিলেন ঠিক তেমনি একইভাবে ওটা কর্তন করলেন। এরপরে বন্ধু-বান্ধবদের দেখলে জিজ্ঞেস করতাম…
“দোস্ত লিঙ্গ আছে না কেটে ফেলেছিস?”
ইউরোপে দেখেছি ভোডাফোন নামে একটা কোম্পানি আছে। বাংলাদেশের কোথাও ওদের শাখা নেই বলেই জানি – কেন নেই সেটা অনুমান করতে একটুও কষ্টও হয় না। ওই নাম নিয়ে আমাদের দেশে ব্যবসায় নামতে অনেক হিম্মত লাগবে বলে মনে হয়।
এই জন্যই আমি ঠিক করেছি যদি কোনোদিন ব্যবসা করি তবে প্রতিষ্ঠানের নাম নিয়ে প্রায় এক বছর গবেষণা চালাবো। বিজনেজ মডেল-টডেল হচ্ছে পরের ব্যাপার আগে দেখতে হবে নিজের অজান্তেই সেমসাইড গোল দিয়ে ফেলেছি নাকি।
সুতরাং সচলের ভাষায়…খুউউউব খিয়াল কইরা…বুঝলেন তো?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

bdnews24.com - Home

ইরান বাংলা নিউজ

বিবিসি বাংলা

দৈনিক সংগ্রাম