
নীলবালক সিন্দাবাদ
মরুযাত্রার ছবিগুলি ঘাটতে গিয়ে দেখলাম শুধু নীলনদেরই কয়েক ডজন ছবি আছে। তখনই মাথায় আসলো, শুধু এই ছবিগুলি দিয়েই তো একটা পর্ব হতে পারে। বিশ্বের দীর্ঘতম নদী – নীলনদ আফ্রিকার রুয়ান্ডার নিয়ুঙ্গে বনের উৎসে প্রথম জন্মলাভ করে রুয়ান্ডা, তানজনিয়ার ভিক্টোরিয়া ফল্স, উগান্ডা, ইথিওপিয়া, সুদান, ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ ঘুরে অবশেষে মিশরে প্রবেশ করে। মিশরের দক্ষিন প্রান্তের মরুঘাঁটি আবু সিম্বেলের নিকটবর্তী সুদান বর্ডার দিয়ে প্রবেশ করে উত্তরে প্রবাহিত হয়ে পুরো দেশ পাড়ি দিয়ে অবশেষে তা উত্তরপ্রান্তের আরেক প্রদেশ দামিয়েতার শহর রাস এল-বারের পাশ দিয়ে তার উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪,১৩০ মাইল অভিযাত্রা শেষে ভূমধ্যসাগরে পতিত হয়। প্রাচীণ মিশরীয় সভ্যতাকে বলা হয় নীলনদের অবদান। এই নীলনদের দু’পারেই গড়ে উঠেছে সেই সভ্যতার বেশির ভাগ বিখ্যাত সব মনুমেন্ট। একে কেন্দ্র করেই মিশরের বেশির ভাগ কৃষি কাজ। এর দুপারেই সম্ভবতঃ সর্বাধিক জনসঙ্খ্যার কেন্দ্রীভবন ও জনবসতি। যুগে যুগে এর উপরেই নির্ভর করেছে তাদের অর্থনীতি। এবং অনাদি কাল থেকে এটাই ছিল তাদের প্রধানতম এবং সহজতম পরিবহন ও যোগাযোগের মাধ্যম। এটাই মিশরের লাইফলাইন, ধমণী, আর্টারি – যাই বলুন। মিশর অংশে নীলনদের দৈর্ঘ্য ঠিক কতটুকু আমি জানিনা। তবে মিশরে তার দক্ষিনের প্রবেশবিন্দুর নিকটতম মরুঘাঁটি আবু সিম্বেল থেকে উত্তরে মোহনাবর্তী শহর রাস এল-বার পর্যন্ত সড়কপথে দূরত্ব বোধহয় ১০০০ মাইলের মতো। আমি এরই মধ্যে বিভিন্ন পয়েন্টে তোলা কিছু ছবি বেছে নিয়েছি। এর মধ্যে আছে : আবু সিম্বেল, আসওয়ান, লুক্সোর, কায়রো, এবং মোহনা রাস এল-বার। তবে এগুলি শুধুই নীলছবি, অর্থাৎ নীলনদের ছবি। কোন ঐতিহাসিক/প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের বা অন্য কোন ছবি এখানে নেই। এই ছবিগুলি আদৌ পোস্ট করবো কিনা তা নিয়ে প্রচুর দ্বিধা সংশয় ছিল। এখনো আছে। আমার চরম আনাড়ি হাতে ২/৩ মেগাপিক্সেলের অতি সস্তা ক্যামেরায় তোলা কিছু বিবর্ন রঙজ্বলা ছবি পোস্ট করে হাস্যস্পদ হওয়া উচিৎ হবে কিনা তা নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছে। যাহোক, সাহস করে শেষমেষ যা থাকে কপালে ভেবে পোস্ট করেই দিলাম !
আরেকটি বিষয়ঃ নীলনদের ব্যপ্তি বা দৈর্ঘ্য এবং এর গতিপথ বুঝতে হলে আপনাকে ম্যাপ দেখতে হবে। রুয়ান্ডা থেকে শুরু করে পুরো নীলনদের ম্যাপ কিছু পাবেন উইকিপিডিয়ায়। নীচে ২১ নং ছবিটাতেও (কালো ফলক) পাবেন সেটা একরকম। আর নীচে পরের ছবিটা শুধু মিশর অংশের ম্যাপ। তার নীচেই আছে মিশর অংশের নীল তীরবর্তী অঞ্চলে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের তথ্যকণিকা ও ইলাস্ট্রেশনসহ চমৎকার ডাউনলোডেবল ম্যাপের একটা লিঙ্ক।

আরো চমৎকার ও বিস্তারিত একটা নীল ম্যাপ ডাউনলোড এখানে।
নীলছবিঃ দক্ষিনে আবু সিম্বেল থেকে উত্তরে রাস এল-বার পর্যন্ত
ক্রকোডাইল আইল্যাণ্ড অভিমুখে
নীলনদ, লুক্সোর।
লুক্সোর হচ্ছে কায়রো থেকে সড়কপথে ৭২১ কি.মি. দক্ষিনে প্রাচীন মিশরের
সবচেয়ে ঐতিহাসিক / প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন-সমৃদ্ধ শহর। আমি কায়রো থেকে ৫
দিনের একটা প্রোগ্রাম করে একসাথে এই লুক্সোর, আসওয়ান (কায়রো থেকে ৯৮২
কি.মি. দক্ষিনে) আর আবু সিম্বেলে (কায়রো থেকে ১২৬২ কি.মি. দক্ষিনে) একটা
চক্কর মেরে আসতে যাই। আমার প্ল্যানে লুক্সোরেই প্রথম এন্ট্রি, আবার এখান
থেকেই কায়রোর পথে এক্সিট। ফেরার দিন বিকেলে ট্রেন, সকালেই হোটেল থেকে
চেক-আউট করি ঐ দিনের বিল বাঁচাতে। এরপর আগে একবার দেখা শহরে আরেক দফা
ঘুরেটুরে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে গেলাম নীল সকাশে। বিকেলের ট্রেন তখনো অনেক
দেরি। সময় কাটাই কিভাবে ? ভাবতে ভাবতে ঘাট থেকে একটা ‘ফেলুক্কা’ (পাল তোলা
নৌকা) ভাড়া করে উঠে পড়লাম। রিটার্ন চুক্তি। গন্তব্য ব্যানানা ও
ক্রকোডাইল আইল্যান্ড। আসল গন্তব্য নদীর হাওয়া খেতে খেতে রিলাক্স করা আর
সময় পার করা। আমার জন্য এটা এক অভূতপূর্ব, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা – কারন জীবনে এর আগে কখনো ‘পাল-তোলা নৌকা’
চড়িনি। তাও আবার দারুন দামাল হাওয়ায় আঁকাবাঁকা গতিপথে ডানেবামে মধুর
ভঙ্গিতে কাত হতে হতে, সুর্যের মিঠেকড়া ওমে বাতাসের শনশনানি আর নদীর
সম্মোহনী কুলকুলানি সঙ্গীত ভেদ করে। কান-ফাটানো কর্কশ ভটভটিয়া দিশি
ইঞ্জিন-বোটের সাথে এর পার্থক্য আমার কাছে স্বর্গ আর নরকের পার্থক্য মনে
হয়েছে। হ্যাঁ, এতই ! সেইসাথে, বলাই বাহুল্য নীলের চতুর্দিকের একজটিক
দৃশ্যাবলী।




নীলনদ, লুক্সোর টুরিস্ট লঞ্চঘাট।
দেবী আইসিসের সন্ধানে
ফিলে দ্বীপ অভিমুখে। নীলনদ, আসওান।


রহস্যময় আইসিস মন্দির। ফিলে দ্বীপ।


ট্র্যাজানস কিয়স্ক । ফিলে দ্বীপ।
ফেরার সময় আবিস্কার করলাম আমাদের মাঝি সাহেব (মনমাঝি না, বোটের মাঝি)
আমাদের এই জনবিচ্ছিন্ন দেবদেবী হন্টেড কিম্ভুতুড়ে দ্বীপে ফেলে হাওয়া হয়ে
গেছেন। বিকেল ৫ টার পরে আবার এখানে কেউ থাকেনা। ৫টা অতিক্রান্ত। অনেকেই
ইতিমধ্যে ফিরে গেছে। আমার সঙ্গীরা বিচলিত। আমি একটু চিন্তিত হলেও অবশ্য
ফিরতি পথে অন্য টুরিস্টদের নৌকায় জায়গা পেতে অসুবিধা হয়নি তেমন। তবে এখন
মনে হয়, ঐ রাতের মতো আটকা পড়ে গেলে কে জানে হয়তো দেবী আইসিসের সঙ্গে
দেখা হয়েও যেতে পারতো ! হয়তো এ্যাপুলেইয়াসের সাথেও। সেবা প্রকাশনীর
‘তিনটি উপন্যাসিকা’র একটি গল্পে বাঙালি নায়কবাবাজি ইজিয়ান সাগরে গ্রীক
পিশাচী মেডুসার রহস্যময় অচিন দ্বীপে আটকা পড়েছিল। সেই ভয়ঙ্করী পিশাচী
মেডুসা, যার প্রতিটি চুল একেকটি জীবন্ত বিষাক্ত সাপ।
যার অব্যাখ্যাত অতিজাগতিক রক্তহিম দৃষ্টি কারো উপর পড়া মাত্র সে পাথরের
মুর্তিতে পরিণত হয় অনন্তকালের জন্য। ঐ দ্বীপে, কাহিণীটা যদ্দুর মনে পড়ে,
দেবতার অভিশাপে পিশাচী মেডুসা নিজেই মুর্তি হয়ে বন্দী ছিল। শুধু সন্ধ্যা
থেকে ভোরের মধ্যকার সময়টা ছাড়া। ঐ সময় সে প্রাণ ফিরে পেত। আর এই সময়ে
কোন মানুষ ঐ দ্বীপে গিয়ে পড়লে তার আর রক্ষা ছিল না ! এই কাহিণী পড়ে,
ছোটবেলা থেকেই আমিও ইজিয়ানের ঐ রহস্যময় দ্বীপে যাওয়ার জন্য ভীষণ উদ্বেল
ছিলাম। তো একইরকম আরেক রহস্যময় দ্বীপ, আইসিসের দ্বীপে গিয়ে মনে হলো,
আইসিসের দ্বীপেও কি ওরকম কিছু হতে পারে না ? পারে না তার মুর্তিগুলিও
জীবন্ত হয়ে উঠতে রাতের বেলা ? তাছাড়া আইসিস তো আর পিশাচী নন, বরং সাক্ষাৎ
জগদ্ধাত্রী ! নাহ্, দারুন মিস করেছি! একটা রাত থেকে গেলেই বোধহয় ভালো
হতো।
নীল ও নীলসন্তান লেক নাসের। আবু সিম্বেল।



কায়রোতে আমার ব্যালকনি থেকে প্রাত্যহিক নীলনদ




কুবরি গামা ওরফে লাভার্স ব্রিজ
১৮/১৯ তলার উপর, প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ফুটবল মাঠের সমান বিশাল
ব্যালকনিতে মরুভূমির দামাল হাওয়া আর শীতের সুর্যের মিঠেকড়া রোদের ওম খেতে
খেতে, বেতের সোফায় কফির কাপ হাতে নিয়ে আধশোয়া ভঙ্গিতে নীলের দিকে
তাকিয়ে থাকার মজাটাই আলাদা।
নীলনদের মোহনা
রাস এল বার, দামিয়েতা। ভূমধ্যসাগর তটে।
পোর্ট সৈয়দ থেকে বেরিয়ে চেনা পথে কায়রো না ফিরে, ম্যাপের বুকে
মরুভূমির মধ্যে সাগরঘেষা লেক মন্টাজালা আর ভূমধ্যসাগরের মাঝখানে ছোট্ট একটা
নখের আঁচড়ের মত দাগকে রাস্তা মনে করে শর্টকাট মেরে নীলের মোহনায় যাওয়ার
জন্যে জনবিরল পথে গাড়ি হাঁকিয়ে দেই সঙ্গীদের শত আপত্তি আর বাধানিষেধ
সত্বেও। শর্টকাটের চেষ্টাটা না করলে অবশ্য যাওয়াই হতো না। ফল যা হওয়ার
তাই হলো – পথ হারানো ! এমনকি স্থানীয়রাও সবাই একবাক্যে বললো – ঐদিকে কোন
রাস্তা নাই। তারপরও গোঁ ধরে যাওয়া হলো। লালাভ মরুভূমির মধ্যে
জনমানবহীণ কুলকিনারাহীণ বিশাল সুনীল অদ্ভুত নিস্তব্ধ লেক – যেন একটা
জ্যান্ত স্থিরচিত্র। অজ্ঞাত গ্রামগঞ্জ।দীর্ঘসময় ধরে নানারকম উলটাপালটা
ঘুরে শেষমেশ দেখা গেল, না, আমার আন্দাজ আর গোয়ার্তুমিই ঠিক ছিল। নখের
আঁচড় নয়, প্রিন্টিং মিসটেক নয়, অন্য কিছুই নয় – সাগর আর লেকের মাঝখানে
ঐটা — রাস্তাই ! অনেক ঘুরে ফিরে অবশেষে লেক মন্টাজালা পেরিয়ে ভূমধ্যসাগর
তীরবর্তী ও নীল-মোহনার পার্শ্ববর্তী শহর রাস এল-বারে পৌঁছালাম। অপূর্ব!
আমার দেখা ইজিপ্টের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর শহর। আসলে এটা মনে হয়
বড়লোকদের ভ্যাকেশন কাটানোর রিসর্ট শহর । রাজসিক সব ভিলায় ঠাসা, অথচ পুরো
শহরটা মনে হচ্ছিল ফাঁকা। কেউ থাকে না যেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ এই শহরের কোন
ছবি নেই আমার কাছে। আর নীচে এখানকার সমুদ্রতীর আর নদী মোহনার রঙজ্বলা
ছবিগুলি যে এর বাস্তব সৌন্দর্যের প্রতি কি নিদারুন অন্যায় আর অবিচার, তা
ফ্লিকারে আরেকজনের এই এবং এই ছবিদুটি দেখলেই বোঝা যাবে।

নীলনদের মোহনায় এই নদের যাত্রা-সমাপ্তি ঘোষনাকারী ফলক

উপরের ফলকের আড়ালে পড়া নকল (?) লাইটহাউজ
উপরের ফলকের উলটো পিঠ। ইংরেজিতে লেখা।

নীলমোহনায় ভূমধ্যসাগর পারে এক অমৃতসিক্ত অলৌকিক বিকেল
http://www.sachalayatan.com/guestwriter/37112
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন