তিব্বত, সে এক অবাক করা নাম, জাদুময় ভূখণ্ড, যার তুলনা কেবলমাত্র সে
নিজেই! হাজার হাজার কিলোমিটার চলে যাওয়া ঊষর, রূক্ষ, পাথুরে ভূমি, পৃথিবীর
উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গগুলোকে বুকে রাখা বিশ্বের সর্বোচ্চ মালভূমি আর বরফগলা
নদীর সমন্বয়ে গঠিত তিব্বতের জুড়ি আক্ষরিক অর্থেই আমাদের গ্রহে দ্বিতীয়টি
নেই। যেমন বিচিত্র এর ভূপ্রকৃতি তেমন বিস্ময় জাগানিয়া এর প্রাণীকুল আর
এখানে বসবাসরত মানব সম্প্রদায়।
এই শতকেও সেখানে মেনে চলা হয় শতাব্দী প্রাচীন রীতিনীতি, রহস্যে মোড়া গুম্ফাগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে পুরোহিতের মন্ত্র, ক্যানভাসে দক্ষ হাতে একের পর এক নয়নজুড়ানো নিপুণ থাংকা (পটচিত্র) এঁকে যায় গেরুয়া রঙের পোশাক মোড়া সন্ন্যাসী চিত্রকরেরা, সাধারণ মানুষ ফিরে যেতে চায় যাযাবরবৃত্তিতে, পশুচারণের আদিম পেশায়। সেই সাথে হাজার বছর ধরেই তিব্বত এক নিষিদ্ধ বিস্ময় বহির্বিশ্বের কাছে, কারণ বিদেশীদের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘ দিন, আজো তা নানা নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলার নিগড়ে ঘেরা।
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে দেখতাম নিষিদ্ধ দেশ- তিব্বত, নিষিদ্ধ নগরী- তিব্বতের রাজধানী লাসা, সেইসব নামগুলো যেন ফেনিয়ে ওঠা গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা, আলো- আঁধারে ঢাকা, খুব জানতে ইচ্ছে করত তাদের সম্পর্কে, কিন্তু জানবার উপায় ছিল না বললেই চলে। নানান বইপত্র ঘেঁটে জানতে পারি ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎপত্তিস্থল অপরূপা মানস সরোবর সেই নিষিদ্ধ মালভূমির অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অবস্থিত, তার সঙ্গী পবিত্র নয়নাভিরাম পর্বত কৈলাস, যাকে তিব্বতিরা মনে করে বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। বৌদ্ধ ও হিন্দু, দুই ধর্মের অনুসারীদের কাছেই কৈলাস তীর্থক্ষেত্র, অতি পবিত্র এই পর্বতে আরোহণের চেষ্টাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান রয়েছে স্থানীয় আইনে, কাজেই সেখানে না হলেও তিব্বতি বৌদ্ধদের কাছে হাজার বছর ধরে অতি পবিত্র বিবেচিত নীলকান্তমণিদেবী বা টেঁকো ঈশ্বর বলে পরিচিত প্রায় সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতার (২৬,৯০৬ ফুট বা ৮,২০১ মিটার, আমাদের গ্রহের ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত) চৌ য়ূ পর্বত শৃঙ্গ অভিযানে ২০০৯ সালের শেষদিকে সৌভাগ্য হয়েছিল সেই স্বপ্নময়, জাদুঘেরা প্রায় মায়াবাস্তবতার আড়ালেই থাকা তিব্বত স্পর্শ করবার, সেই গল্পই তুলে ধরছি আপনাদের কাছে।
সে বছরের ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরের খানিক আগে আমরা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে জিপগাড়ীতে করে তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত কোদারী শহরে পৌছাই, আমরা বলতে পর্বতারোহণের সঙ্গী শেরপারা, সেই সাথে দুজন বঙ্গসন্তান অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এম এ মুহিত ( উল্লেখ্য মুহিত ভাই এই মাসেই বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানাসলু পর্বত জয়ের মাধ্যমে একমাত্র বাঙালি হিসেবে তিন তিনটি ৮০০০ মিটার উচ্চতার পর্বত জয়ের অনন্য গর্বের অধিকারী হয়েছেন, অন্য দুটি ছিল চৌ য়ূ এবং মাউন্ট এভারেস্ট) ও আমি, তারেক অণু।
এর আগে আমরা হিমালয়কন্যা নেপালে আসলেও এই প্রথমবারের মত তিব্বতের নিষিদ্ধ ভূখণ্ডে পা রাখতে যাচ্ছি, মনের কোণে উৎসাহের বাণ ডেকেছে। হিমালয় থেকে বয়ে আসা বটেকোশী নদীর উপরে নির্মিত এক সেতু সংযোগ করেছে এই দুই দেশকে, সেদিকে এক পলক পড়তেই যেন ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিল খালি চোখেই, নেপালের সীমানায় কোনমতে দাড় করানো কয়েকটা ভবন, অনেকটা ছাপরা ধরনের কিছু খাবার দোকান, জনা কয়েক পুলিশ- এই শেষ! অন্যদিকে তিব্বত সীমান্তের ভিতরে চীনা মিলিটারির প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গ, সারি সারি ভবন, সর্বদাই টহলরত অস্ত্রধারী মিলিটারি। সর্বক্ষণের কড়া পাহারা যেন দর্শনার্থীদের কেউ সীমান্তবর্তী কোন স্থাপনা বিশেষ করে সেতুটার ছবি তুলতে না পারে।
কাছের দেশ মানজ্বালা (বাংলাদেশের চীনে নাম) থেকে আসলেও ভিসার ঝামেলা শেষ করতে বেশ খানিকক্ষণ লেগে গেল, উল্লেখ্য ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের জন্য গত দুই বছর ধরেই চীন সরকার যে কোনরকম রাজনৈতিক গোলযোগ এড়ানোর জন্য তিব্বতে কোনরকম পর্বতাভিযান চালানোর অনুমতি দেয় নি। কাস্টমসের গোমড়ামুখো চীনা পুলিশ কর্মকর্তার মূল আকর্ষণ ছিল সাথে বয়ে আনা চারখানা বই, সেগুলো কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা দালাই লামার বাণী সম্বলিত কিনা তা বোঝার জন্য যেন রীতিমত যুদ্ধ অভিযান চলল পাতার পর পাতা উল্টে, তবে আমার নিরেট মাথায় কিছুতেই ঢুকল না কেন সেই উচ্চশিক্ষিত সরকারী কর্মচারীরা আমার প্রতিটি ইংরেজি বই উল্টো করে ধরে যাচাই করলেন! সেই সাথে প্রত্যেকের ব্যাগে চলল চিরুনি তল্লাসি, আমরা পার পেয়ে গেলেও এক ব্রাজিলীয় পর্যটকের ব্যাগে মিলল তিব্বতের পতাকা, সাথে সাথে ভিসা থাকা স্বত্বেও প্রবেশাধিকার বাতিল হয়ে গেল তার! অন্যদের মুখে শুনলাম কারো সাথে মাও সে তুং বিরোধী কোন বই বা লিফলেট এমনকি দালাই লামার ছবি থাকলেও তার কপালে একই পরিণতি ঘটত। যদিও এক সতীর্থ আমেরিকান চোখ টিপে দুষ্টু হাসি দিয়ে জানাল তার শার্টের নিচের উল্কি আঁকা আছে স্বাধীন তিব্বতের দাবীতে!
সীমান্তের অতি কাছেই মেঘের কোলে ঠাই নেওয়া জাংমু শহরের আমাদের আপাত অবস্থান আর জলখাবারের ব্যবস্থা ছিল।
সব জায়গাতেই তিব্বতি মহিলাদের কর্ম তৎপরতা চোখে পড়ার মত, মিষ্টি হেসে তারা সম্বোধনের ভঙ্গীতে দুহাত জোড় করে বলে থাসিডেলি- তিব্বতি ভাষায় নমস্তে।
খানিক বিশ্রামের পরপরই গাড়ী করে দারুণ পিচ ঢালা রাস্তায় ৩৬৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ক্ষুদে জনপদ নায়লাম-এ আগমন। রাস্তাটির অতি অল্প অংশ তখনো নির্মাণাধীন থাকলেও কেবল মনে হচ্ছিল এই দুর্গম বন্ধুর এলাকায় হিমালয়ের বুক চিরে কি করে চীনে প্রকৌশলীরা এই বিস্ময়কর পথ নির্মাণ করেই ছাড়ল! তবে এটিও ঠিক, মনের অজান্তেই খচ খচ করে বিঁধছিল তিব্বতের মত স্বপ্নময় অগম্য স্থানে এমনভাবে যান্ত্রিক শকটে আগমন, এর চেয়ে ইয়াকের পিঠে আসলেই আমাদের প্রবেশ বেশী সার্থক মনে হত।
নায়লামে তখন দারুণ ঠাণ্ডা, কনকনে পাহাড়ি বাতাস মনের সুখে খোলা চামড়ায় চাবুক হেনে চলেছে, তার সঙ্গী সুতীক্ষ তীরের মতই যন্ত্রণাময় বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি, সেই সাথে পদ্মাপারের সমতলের মানুষের হঠাৎ করেই এতটা উঁচুতে অনেক কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাসে আসার কারণে স্বল্প মাথা ব্যাথা। এই কম অক্সিজেনময় বাতাসে খাপ খাওয়ানোর জন্যই আস্তানা গাড়া হল দিন দুইয়ের জন্য নাইলামের হোটেল স্নো ল্যান্ডে। অন্যান্য অনেক কিছুর সাথেই বিখ্যাত তিব্বতি চা ( প্রতি কাপে কমপক্ষে দুই চামচ লবণ আর ইয়াকের দুধের এক ডেলা মাখন, সেই চায়ে আবার ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ, বাঙালি রসনার জন্য মোটেই উপাদেয় কিছু নয়) দিয়ে প্রাতরাশ সেরে প্রতিদিনই হাইকিং করতে হত উচ্চতার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য। পথে নজরে আসে তিব্বতিদের আলু ক্ষেত, ইয়াকের সাহায্যে লাঙ্গল টানা,
যাযাবর পশুপালকদের আস্তানা, ভেড়া- ছাগলের পাল গণনা করে কাঠমান্ডুর পুঁজোর জন্য প্রস্তুত করা। ভেড়া গণনার সময় অবাক হয়ে শুনলাম এক থেকে দশ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যার উচ্চারণ তিব্বতি ও বাংলায় হুবহু এক!
এত উঁচুতে কি শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে গিরিরাজ অপেক্ষমাণ আমাদের জন্য, দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে বটেকোশী নদী দেখা যায়, চারদিকে সবুজে ছাওয়া পর্বতমালা, আরো দূরে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। ধীরে ধীরে এই বাতাসে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে আমাদের শরীর, সেই সাথে বাড়ছে ফুসফুসের সহ্যক্ষমতা, পর্বতারোহণের জন্য যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রেকিং শেষে ফেরার পথে চোখে পড়ে ক্রীড়ারত তিব্বতি শিশু, ইয়াকের মাংস নিয়ে খোলা জায়গায় কসাইয়ের দোকান, অতি সুসজ্জিত চাইনীজ মিলিটারির অফিস।
পরে খুজে খুজে এক সাইবার ক্যাফে পেয়ে সেখানে ঢুকতেই চক্ষুচড়কগাছ, তিব্বতি ছেলেছোকরারা ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে বসে গেম খেলছে দস্তুরমত, ভিড়ের ঠেলায় মিনিট কয়েক বসেই চলে আসলাম, এর মাঝেই জানা হয়ে গেল এক মূল্যবান আবিস্কার- চৈনিক ভূখণ্ডে ফেসবুক নামক বস্তুটিতে প্রবেশ সম্ভব নহে! এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সব ব্যবসার মালিকই তিব্বতে গত কয়েক দশকে আসা হান চাইনিজরা। মনের গহনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে- এই কি আমার স্বপ্নের তিব্বত, যেখানে যন্ত্র সভ্যতাতেই অভ্যস্ত সবাই, অধিকাংশ স্থানীয় শিশুর গায়ে ধুলোধূসরিত মলিন পোশাক, কাক ভোরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভরাট কণ্ঠের ওম মণি পদ্মে হুম মন্ত্রের বদলে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিলিটারি মার্চপাস্টের উৎকট চিৎকারে!
এক ভোরে যাত্রা শুরু হল নাইলাম থেকে, মাইলের পর মাইল রূক্ষ, ঊষর, আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন, অনুর্বর তিব্বতের মালভূমি, পর্বত আর উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত অদ্বিতীয় ভূপ্রকৃতি, এর মাঝে চড়াই-উৎরাই, মালভূমি, উপত্যকা, নদী এমনকি বরফাচ্ছাদিত পর্বত শিখর প্রায় অতিক্রম করে চলে গেছে মানুষের তৈরি উচ্চতম সড়ক, এত মসৃণ সে রাস্তা, এমন নিপুণ দক্ষতায় এর সমাপ্তি টানা হয়েছে যে মাখনের তৈরি বলে ভ্রম হয়, আর চলে গেছে এই গ্রহের বন্ধুরতম জায়গার মাঝ দিয়ে! জানা গেল বেইজিং অলিম্পিকের জন্য মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্প পর্যন্ত এই পিচ ঢালা পথ নিয়ে যাবার মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সে দেশের সরকার, অবধারিত ভাবেই নামমাত্র সন্মানিতে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় দরিদ্র তিব্বতিরা।
পথে মনের পর্দায় রূপকথার আমেজ ছড়ানো তিব্বতি গ্রামগুলো দর্শন দিতে লাগল একে একে, কোন কোন গ্রামের উঁচু জায়গায় বৌদ্ধমন্দির, অনেক গ্রামেই বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেলের চল দেখা গেল। ইয়াক, ভেড়া, পার্বত্য ছাগল, টাট্টু ঘোড়ার পাল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত পশুপালক ও তাদের রাস্তা জুড়ে অবরোধ করে থাকা পশুর পালের জন্য গাড়ী থামাতে হল বেশ কবার।
বিচিত্র সেই রাখালদের বেশভূষা, লম্বা কালো চুল নানা বিচিত্র ভাবে বিন্যাস করা, কারো কারো এক কানে বিশাল মাকড়ি, মাথায় টুপি, এককালের রঙচঙে কাপড় বহু ব্যবহারে বিবর্ণ। অনেক শিশুকেও দেখা গেল চারণ কাজে নিয়োজিত থাকতে।
নয়নমনোহর এদের বাড়ীগুলো, অধিকাংশই সাদারঙের হলেও জানালগুলো নানা রঙে ঝলমল, সেই সাথে বাড়ীর দেয়ালের উপরে ইয়াকের ঘুঁটে শুকাবার প্রচেষ্টা। প্রতিটি লোকালয়েই একদল কুকুর সদা প্রহরারত, বিশালাকৃতির রোমশ কুকুরগুলো স্থানীয়দের চোখের মণি।
বড় বিরতি হয়েছিল প্রায় ৫০০০ মিটার উচ্চতায় এক প্রায় সমতল জায়গায়, উদ্দেশ্য বিশ্বের ১৪তম উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সিসাপাংমাকে অবলোকন ও এই বিস্ময়কে আলোকচিত্রে ধারণ করবার চেষ্টা চালানো। ৮০০০ মিটারের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ( পৃথিবীতে এমন পর্বতশৃঙ্গ আছে মাত্র ১৪ টা, সবই হিমালয়ে) ধবধবে সাদা বরফাচ্ছাদিত সিসাপাংমা দাড়িয়ে আছে দিগন্তকে আড়াল করে, অন্যপাশে আরেক বিখ্যাত শৃঙ্গ গৌরিশঙ্কর।
এর পরে আবার ঢাল বেয়ে নিচের পানে, দর্শন মেলে চৌ য়ূ এবং পর্বতাধিপতি চো মু লাংমার ( এভারেস্টের তিব্বতি নাম)।
কিন্তু মনের পর্দায় সবসময় ভাসতে থাকে তিব্বতের সেই অপার্থিব ভয়ংকর সৌন্দর্যময় ঊষরভূমির কথা, হয়তো এতটা রূক্ষ বলেই তিব্বতের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে এতো অলঙ্ঘনীয়, অমোঘ, হাজার বছর ধরে সে আছে ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে! মনটা একটু ভারই ছিল শেষ পর্যন্ত মাত্র একজনের স্পন্সরের টাকা জোগাড় হওয়ায় নিজের টাকাটা পুরোপুরি মানিব্যাগ থেকেই দিতে হচ্ছিল ( টাকার অঙ্ক জানার দরকার নেই, কিন্তু যেহেতু ৮০০০ মিটারের যে কোন পর্বতই অত্যন্ত ব্যয়বহুল, শুধু জানিয়ে রাখি ঐ এক পর্বতে ব্যয়কৃত অর্থ দিয়েই সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকা ঘোরা হয়ে যায়) , কিন্তু তিব্বতের এমন আদিগন্ত বিস্তৃত রূপশোভা দেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেবল মনে হয়েছে ভাগ্যিস গিয়েছিলাম তিব্বতে, না হলে এই ক্ষুদ্র মানবজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
সেই সাথে এত ভুললেও চলবে না যে কারণে পলিমাটি দিয়ে তৈরি আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ যে কারণে এত উর্বর, সেই একই কারণে তিব্বত এত মরুময়, শুষ্ক! কারণটা, গিরিরাজ হিমালয়। এক বিশাল প্রাচীরের মত সীমানা আগলে দাড়িয়ে আছে তা, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘ কোনমতেই সেই সুউচ্চ বাঁধা ডিঙ্গাতে পারে না, ফলশ্রুতিতে জীবনদায়ী বৃষ্টিপাত একতরফা ভাবে সবসময়ই পক্ষপাতিত্ব করে আমাদের দিকটাতে, গড়ে তোলে উর্বর ভূমি আর হিমালয় প্রাচীরের অন্য পাশে তিব্বত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে শুষ্ক, রিক্ত।
পরের গন্তব্য গোটা পঞ্চাশেক বাড়ী আর হোটেলের এক ক্ষুদে জনপদ তিংরি, উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২০০ মিটার, পশ্চিমে শত শত মাইল চলে গেছে তিব্বতের রূক্ষ মালভূমি আর পূর্ব দিগন্তে দৃষ্টি যাবার অনেক অনেক আগেই তা আটকে পড়ে সমগ্র বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করা মাউন্ট এভারেস্টে!
তিংরির হোটেলের যে সদা তৎপর দিদিমা পাহারাদার থেকে শুরু করে হেসেলদারের কাজ পর্যন্ত করতেন তার শতভাজ পড়া মুখের রেখাগুলো বলে দেয় শতবর্ষের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন এই কর্মঠ মহিলা। এ এক জিনিস আমরা দেখেছি হিমালয়ের অধিবাসীদের মাঝে- অদম্য প্রাণশক্তি, নির্মেদ শরীর, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমরত। সেখানে লাঠি অবলম্বনরত কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অনেকের হাতেই একমাত্র সম্বল জপমালা বা জপযন্ত্র।
তবে তিতিবিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম সেখানকার খাবারে, তিব্বতিদের প্রধান খাবার চমবা( গম ও যবের সমন্বয়ে তৈরি) আমাদের দেওয়া হত না, পাতে পড়ত মাত্রাতিরিক্ত তেলে ভাজা সবজি, ডিম, কখনো ইয়াকের মাংস। সেই রান্নায় না ছিল কোন নুন, না কোন ঝাল!
শেষে তিংরি বাজারে অবস্থিত এক নামকাওয়াস্তে নেপালি রেস্তোরাঁ ছিল অকূল পাথারে শেষ ভরসা। সেখানকার বাজারগুলোতে যেন ধুলো সবসময় থৈ থৈ করছে, কসাইয়ের দোকানে ঝোলানো ভেড়া বা ইয়াকের মাংসে ধুলোর পুরু আস্তরণ, তিব্বতিদের শরীরেও তাই, এমনিতেই আবার তাদের নামে দুর্নাম আছে স্নান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকার।
স্থানীয়রা অনেকেই ছবি তুললে টাকা দাবি করে। পথে এক ক্যাম্পের তত্বাবধানকারী মহিলা আমার গলায় ঝোলানো বাংলাদেশের গামছাটি খুব পছন্দ করাই একটি চমৎকার টুপির সাথে বিনিময়ের প্রস্তাব দেয়, আমিও সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করি তবে সেই লোমশ টুপির বদলে নয়, তার দুটি ছবি তোলার অনুমতির বিনিময়ে।
তিব্বতের প্রায় ৮০০ জনবসতির আরো কয়েকটি ঘুরে আমরা রওনা দেয় গন্তব্যের পানে, সুউচ্চ পর্বত শিখরে। পথে দেখা মিলল এক ঝাক লামাগায়ারের সাথে, অদ্ভুত এক ভয়াল বুনো সৌন্দর্যের অধিকারী সরাসরি হাড় খাওয়ার ক্ষমতাধারী পাখিরাজ্যের একমাত্র বিস্ময় এই দাড়িওয়ালা শকুন। তার সুষমামণ্ডিত উড়াল যে কোন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানকেও হার মানাবে। ওরা মনে হয় উপর থেকে হাড় ফেলে ভাঙ্গার জন্য পাথুরে চাতাল খুঁজছিল। আরো দেখা হয় ইদুর জাতীয় প্রাণী পাইকা, বিশালাকার সোনালী ঈগল আর হঠাৎ করেই সামনে আসা পাহাড়ি অ্যান্টিলোপের পালের সাথে।
আবহাওয়া ভাল থাকাই সফল অভিযান শেষে অনুমিত সময়ের বেশ কদিন আগেই লোকালয়ে ফিরি আমরা, হাতে সময় থাকায় মন রোমাঞ্চে ভরে ওঠে লাসায় অবস্থিত দালাই লামার পোতালা প্যালেস ও বাচ্চাবেলার স্বপ্ন মানস সরোবর দেখার সম্ভাবনায়। কিন্তু গুড়ে বালি দিয়ে সাথের গাইড ও অন্যরা জানালো তিব্বতের ভিসার নিয়ম অত্যন্ত কড়া এবং জটিল। চীন সরকার আমাদের যে রাস্তা ও গন্তব্যের জন্য ভিসা দিয়েছে আমরা এর ব্যতিক্রম কোন ভাবেই করতে পারব না! কাজেই হাতে সময় থাকা স্বত্বেও এবারের মত ফিরতে হবে, মানস বা কৈলাস দেখতে চাইলে আবার আবেদন করতে হবে নতুন ভিসার। কোন গুম্ফা দেখার আশাও পরিত্যাগ করতে হল, ১৯৪৯ সালে তিব্বতে ছয় হাজারের উপর বৌদ্ধ মন্দির থাকলেও এখন হাতে গোনা, অতি সীমিত, রাস্তায় রাস্তায় লামা দর্শন হয় নি আমাদের, বরং এর চেয়ে বেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাথে পরিচয় ঘটে নেপালের রাস্তায়।
এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে সীমান্তে ফিরি সবাই, তিব্বতের অনন্যসাধারণ ভূপ্রকৃতির প্রতি বিস্ময়ভরা মুগ্ধতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে।
(প্রিয় সচলের বন্ধুরা, আমাদের তিব্বত অভিযান নিয়ে একটি সংক্ষেপিত লেখা
৩টি ছবি সহ দেশের এক দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল কয়েক বছর আগে, কিন্তু সেটি
ছিল অনেক সংক্ষিপ্ত ও সেন্সরের কাঁচি চালানো, এখানে পুরো লেখাটাই রইল,
আপনাদের ভাল লাগলে তিব্বত নিয়ে পর্যায়ক্রমে আরও লিখার ইচ্ছে থাকল)
মূল লিঙ্কঃ http://www.sachalayatan.com/node/41685
এই শতকেও সেখানে মেনে চলা হয় শতাব্দী প্রাচীন রীতিনীতি, রহস্যে মোড়া গুম্ফাগুলোর দেয়ালে প্রতিধ্বনি তোলে পুরোহিতের মন্ত্র, ক্যানভাসে দক্ষ হাতে একের পর এক নয়নজুড়ানো নিপুণ থাংকা (পটচিত্র) এঁকে যায় গেরুয়া রঙের পোশাক মোড়া সন্ন্যাসী চিত্রকরেরা, সাধারণ মানুষ ফিরে যেতে চায় যাযাবরবৃত্তিতে, পশুচারণের আদিম পেশায়। সেই সাথে হাজার বছর ধরেই তিব্বত এক নিষিদ্ধ বিস্ময় বহির্বিশ্বের কাছে, কারণ বিদেশীদের অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল দীর্ঘ দিন, আজো তা নানা নিয়ম-কানুন-শৃঙ্খলার নিগড়ে ঘেরা।
ছোটবেলায় সাধারণ জ্ঞানের বইতে দেখতাম নিষিদ্ধ দেশ- তিব্বত, নিষিদ্ধ নগরী- তিব্বতের রাজধানী লাসা, সেইসব নামগুলো যেন ফেনিয়ে ওঠা গাঢ় রহস্যের কুয়াশায় ঘেরা, আলো- আঁধারে ঢাকা, খুব জানতে ইচ্ছে করত তাদের সম্পর্কে, কিন্তু জানবার উপায় ছিল না বললেই চলে। নানান বইপত্র ঘেঁটে জানতে পারি ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎপত্তিস্থল অপরূপা মানস সরোবর সেই নিষিদ্ধ মালভূমির অবিশ্বাস্য উচ্চতায় অবস্থিত, তার সঙ্গী পবিত্র নয়নাভিরাম পর্বত কৈলাস, যাকে তিব্বতিরা মনে করে বিশ্বের কেন্দ্রস্থল। বৌদ্ধ ও হিন্দু, দুই ধর্মের অনুসারীদের কাছেই কৈলাস তীর্থক্ষেত্র, অতি পবিত্র এই পর্বতে আরোহণের চেষ্টাকারীকে মৃত্যুদন্ড দেবার বিধান রয়েছে স্থানীয় আইনে, কাজেই সেখানে না হলেও তিব্বতি বৌদ্ধদের কাছে হাজার বছর ধরে অতি পবিত্র বিবেচিত নীলকান্তমণিদেবী বা টেঁকো ঈশ্বর বলে পরিচিত প্রায় সাতাশ হাজার ফুট উচ্চতার (২৬,৯০৬ ফুট বা ৮,২০১ মিটার, আমাদের গ্রহের ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত) চৌ য়ূ পর্বত শৃঙ্গ অভিযানে ২০০৯ সালের শেষদিকে সৌভাগ্য হয়েছিল সেই স্বপ্নময়, জাদুঘেরা প্রায় মায়াবাস্তবতার আড়ালেই থাকা তিব্বত স্পর্শ করবার, সেই গল্পই তুলে ধরছি আপনাদের কাছে।
সে বছরের ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরের খানিক আগে আমরা নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে জিপগাড়ীতে করে তিব্বত সীমান্তে অবস্থিত কোদারী শহরে পৌছাই, আমরা বলতে পর্বতারোহণের সঙ্গী শেরপারা, সেই সাথে দুজন বঙ্গসন্তান অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এম এ মুহিত ( উল্লেখ্য মুহিত ভাই এই মাসেই বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ মানাসলু পর্বত জয়ের মাধ্যমে একমাত্র বাঙালি হিসেবে তিন তিনটি ৮০০০ মিটার উচ্চতার পর্বত জয়ের অনন্য গর্বের অধিকারী হয়েছেন, অন্য দুটি ছিল চৌ য়ূ এবং মাউন্ট এভারেস্ট) ও আমি, তারেক অণু।
এর আগে আমরা হিমালয়কন্যা নেপালে আসলেও এই প্রথমবারের মত তিব্বতের নিষিদ্ধ ভূখণ্ডে পা রাখতে যাচ্ছি, মনের কোণে উৎসাহের বাণ ডেকেছে। হিমালয় থেকে বয়ে আসা বটেকোশী নদীর উপরে নির্মিত এক সেতু সংযোগ করেছে এই দুই দেশকে, সেদিকে এক পলক পড়তেই যেন ধনী-গরীবের অর্থনৈতিক পার্থক্যটা প্রকট হয়ে ধরা দিল খালি চোখেই, নেপালের সীমানায় কোনমতে দাড় করানো কয়েকটা ভবন, অনেকটা ছাপরা ধরনের কিছু খাবার দোকান, জনা কয়েক পুলিশ- এই শেষ! অন্যদিকে তিব্বত সীমান্তের ভিতরে চীনা মিলিটারির প্রায় দুর্ভেদ্য দুর্গ, সারি সারি ভবন, সর্বদাই টহলরত অস্ত্রধারী মিলিটারি। সর্বক্ষণের কড়া পাহারা যেন দর্শনার্থীদের কেউ সীমান্তবর্তী কোন স্থাপনা বিশেষ করে সেতুটার ছবি তুলতে না পারে।
কাছের দেশ মানজ্বালা (বাংলাদেশের চীনে নাম) থেকে আসলেও ভিসার ঝামেলা শেষ করতে বেশ খানিকক্ষণ লেগে গেল, উল্লেখ্য ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের জন্য গত দুই বছর ধরেই চীন সরকার যে কোনরকম রাজনৈতিক গোলযোগ এড়ানোর জন্য তিব্বতে কোনরকম পর্বতাভিযান চালানোর অনুমতি দেয় নি। কাস্টমসের গোমড়ামুখো চীনা পুলিশ কর্মকর্তার মূল আকর্ষণ ছিল সাথে বয়ে আনা চারখানা বই, সেগুলো কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত কিংবা দালাই লামার বাণী সম্বলিত কিনা তা বোঝার জন্য যেন রীতিমত যুদ্ধ অভিযান চলল পাতার পর পাতা উল্টে, তবে আমার নিরেট মাথায় কিছুতেই ঢুকল না কেন সেই উচ্চশিক্ষিত সরকারী কর্মচারীরা আমার প্রতিটি ইংরেজি বই উল্টো করে ধরে যাচাই করলেন! সেই সাথে প্রত্যেকের ব্যাগে চলল চিরুনি তল্লাসি, আমরা পার পেয়ে গেলেও এক ব্রাজিলীয় পর্যটকের ব্যাগে মিলল তিব্বতের পতাকা, সাথে সাথে ভিসা থাকা স্বত্বেও প্রবেশাধিকার বাতিল হয়ে গেল তার! অন্যদের মুখে শুনলাম কারো সাথে মাও সে তুং বিরোধী কোন বই বা লিফলেট এমনকি দালাই লামার ছবি থাকলেও তার কপালে একই পরিণতি ঘটত। যদিও এক সতীর্থ আমেরিকান চোখ টিপে দুষ্টু হাসি দিয়ে জানাল তার শার্টের নিচের উল্কি আঁকা আছে স্বাধীন তিব্বতের দাবীতে!
সীমান্তের অতি কাছেই মেঘের কোলে ঠাই নেওয়া জাংমু শহরের আমাদের আপাত অবস্থান আর জলখাবারের ব্যবস্থা ছিল।
সব জায়গাতেই তিব্বতি মহিলাদের কর্ম তৎপরতা চোখে পড়ার মত, মিষ্টি হেসে তারা সম্বোধনের ভঙ্গীতে দুহাত জোড় করে বলে থাসিডেলি- তিব্বতি ভাষায় নমস্তে।
খানিক বিশ্রামের পরপরই গাড়ী করে দারুণ পিচ ঢালা রাস্তায় ৩৬৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ক্ষুদে জনপদ নায়লাম-এ আগমন। রাস্তাটির অতি অল্প অংশ তখনো নির্মাণাধীন থাকলেও কেবল মনে হচ্ছিল এই দুর্গম বন্ধুর এলাকায় হিমালয়ের বুক চিরে কি করে চীনে প্রকৌশলীরা এই বিস্ময়কর পথ নির্মাণ করেই ছাড়ল! তবে এটিও ঠিক, মনের অজান্তেই খচ খচ করে বিঁধছিল তিব্বতের মত স্বপ্নময় অগম্য স্থানে এমনভাবে যান্ত্রিক শকটে আগমন, এর চেয়ে ইয়াকের পিঠে আসলেই আমাদের প্রবেশ বেশী সার্থক মনে হত।
নায়লামে তখন দারুণ ঠাণ্ডা, কনকনে পাহাড়ি বাতাস মনের সুখে খোলা চামড়ায় চাবুক হেনে চলেছে, তার সঙ্গী সুতীক্ষ তীরের মতই যন্ত্রণাময় বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি, সেই সাথে পদ্মাপারের সমতলের মানুষের হঠাৎ করেই এতটা উঁচুতে অনেক কম অক্সিজেন সমৃদ্ধ বাতাসে আসার কারণে স্বল্প মাথা ব্যাথা। এই কম অক্সিজেনময় বাতাসে খাপ খাওয়ানোর জন্যই আস্তানা গাড়া হল দিন দুইয়ের জন্য নাইলামের হোটেল স্নো ল্যান্ডে। অন্যান্য অনেক কিছুর সাথেই বিখ্যাত তিব্বতি চা ( প্রতি কাপে কমপক্ষে দুই চামচ লবণ আর ইয়াকের দুধের এক ডেলা মাখন, সেই চায়ে আবার ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ, বাঙালি রসনার জন্য মোটেই উপাদেয় কিছু নয়) দিয়ে প্রাতরাশ সেরে প্রতিদিনই হাইকিং করতে হত উচ্চতার সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য। পথে নজরে আসে তিব্বতিদের আলু ক্ষেত, ইয়াকের সাহায্যে লাঙ্গল টানা,
যাযাবর পশুপালকদের আস্তানা, ভেড়া- ছাগলের পাল গণনা করে কাঠমান্ডুর পুঁজোর জন্য প্রস্তুত করা। ভেড়া গণনার সময় অবাক হয়ে শুনলাম এক থেকে দশ পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যার উচ্চারণ তিব্বতি ও বাংলায় হুবহু এক!
এত উঁচুতে কি শ্বাসরুদ্ধকর সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে গিরিরাজ অপেক্ষমাণ আমাদের জন্য, দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে বটেকোশী নদী দেখা যায়, চারদিকে সবুজে ছাওয়া পর্বতমালা, আরো দূরে তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গ। ধীরে ধীরে এই বাতাসে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে আমাদের শরীর, সেই সাথে বাড়ছে ফুসফুসের সহ্যক্ষমতা, পর্বতারোহণের জন্য যা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
ট্রেকিং শেষে ফেরার পথে চোখে পড়ে ক্রীড়ারত তিব্বতি শিশু, ইয়াকের মাংস নিয়ে খোলা জায়গায় কসাইয়ের দোকান, অতি সুসজ্জিত চাইনীজ মিলিটারির অফিস।
পরে খুজে খুজে এক সাইবার ক্যাফে পেয়ে সেখানে ঢুকতেই চক্ষুচড়কগাছ, তিব্বতি ছেলেছোকরারা ইন্টারনেট ক্যাফেতে বসে বসে গেম খেলছে দস্তুরমত, ভিড়ের ঠেলায় মিনিট কয়েক বসেই চলে আসলাম, এর মাঝেই জানা হয়ে গেল এক মূল্যবান আবিস্কার- চৈনিক ভূখণ্ডে ফেসবুক নামক বস্তুটিতে প্রবেশ সম্ভব নহে! এই শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় সব ব্যবসার মালিকই তিব্বতে গত কয়েক দশকে আসা হান চাইনিজরা। মনের গহনে প্রশ্নের ঝড় ওঠে- এই কি আমার স্বপ্নের তিব্বত, যেখানে যন্ত্র সভ্যতাতেই অভ্যস্ত সবাই, অধিকাংশ স্থানীয় শিশুর গায়ে ধুলোধূসরিত মলিন পোশাক, কাক ভোরে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর ভরাট কণ্ঠের ওম মণি পদ্মে হুম মন্ত্রের বদলে ঘুম ভেঙ্গে যায় মিলিটারি মার্চপাস্টের উৎকট চিৎকারে!
এক ভোরে যাত্রা শুরু হল নাইলাম থেকে, মাইলের পর মাইল রূক্ষ, ঊষর, আপাতদৃষ্টিতে প্রাণহীন, অনুর্বর তিব্বতের মালভূমি, পর্বত আর উপত্যকার সমন্বয়ে গঠিত অদ্বিতীয় ভূপ্রকৃতি, এর মাঝে চড়াই-উৎরাই, মালভূমি, উপত্যকা, নদী এমনকি বরফাচ্ছাদিত পর্বত শিখর প্রায় অতিক্রম করে চলে গেছে মানুষের তৈরি উচ্চতম সড়ক, এত মসৃণ সে রাস্তা, এমন নিপুণ দক্ষতায় এর সমাপ্তি টানা হয়েছে যে মাখনের তৈরি বলে ভ্রম হয়, আর চলে গেছে এই গ্রহের বন্ধুরতম জায়গার মাঝ দিয়ে! জানা গেল বেইজিং অলিম্পিকের জন্য মাউন্ট এভারেস্টের বেসক্যাম্প পর্যন্ত এই পিচ ঢালা পথ নিয়ে যাবার মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সে দেশের সরকার, অবধারিত ভাবেই নামমাত্র সন্মানিতে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহৃত হয় দরিদ্র তিব্বতিরা।
পথে মনের পর্দায় রূপকথার আমেজ ছড়ানো তিব্বতি গ্রামগুলো দর্শন দিতে লাগল একে একে, কোন কোন গ্রামের উঁচু জায়গায় বৌদ্ধমন্দির, অনেক গ্রামেই বিদ্যুতের জন্য সোলার প্যানেলের চল দেখা গেল। ইয়াক, ভেড়া, পার্বত্য ছাগল, টাট্টু ঘোড়ার পাল নিয়ে ব্যতিব্যস্ত পশুপালক ও তাদের রাস্তা জুড়ে অবরোধ করে থাকা পশুর পালের জন্য গাড়ী থামাতে হল বেশ কবার।
বিচিত্র সেই রাখালদের বেশভূষা, লম্বা কালো চুল নানা বিচিত্র ভাবে বিন্যাস করা, কারো কারো এক কানে বিশাল মাকড়ি, মাথায় টুপি, এককালের রঙচঙে কাপড় বহু ব্যবহারে বিবর্ণ। অনেক শিশুকেও দেখা গেল চারণ কাজে নিয়োজিত থাকতে।
নয়নমনোহর এদের বাড়ীগুলো, অধিকাংশই সাদারঙের হলেও জানালগুলো নানা রঙে ঝলমল, সেই সাথে বাড়ীর দেয়ালের উপরে ইয়াকের ঘুঁটে শুকাবার প্রচেষ্টা। প্রতিটি লোকালয়েই একদল কুকুর সদা প্রহরারত, বিশালাকৃতির রোমশ কুকুরগুলো স্থানীয়দের চোখের মণি।
বড় বিরতি হয়েছিল প্রায় ৫০০০ মিটার উচ্চতায় এক প্রায় সমতল জায়গায়, উদ্দেশ্য বিশ্বের ১৪তম উচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সিসাপাংমাকে অবলোকন ও এই বিস্ময়কে আলোকচিত্রে ধারণ করবার চেষ্টা চালানো। ৮০০০ মিটারের অধিক উচ্চতা বিশিষ্ট ( পৃথিবীতে এমন পর্বতশৃঙ্গ আছে মাত্র ১৪ টা, সবই হিমালয়ে) ধবধবে সাদা বরফাচ্ছাদিত সিসাপাংমা দাড়িয়ে আছে দিগন্তকে আড়াল করে, অন্যপাশে আরেক বিখ্যাত শৃঙ্গ গৌরিশঙ্কর।
এর পরে আবার ঢাল বেয়ে নিচের পানে, দর্শন মেলে চৌ য়ূ এবং পর্বতাধিপতি চো মু লাংমার ( এভারেস্টের তিব্বতি নাম)।
কিন্তু মনের পর্দায় সবসময় ভাসতে থাকে তিব্বতের সেই অপার্থিব ভয়ংকর সৌন্দর্যময় ঊষরভূমির কথা, হয়তো এতটা রূক্ষ বলেই তিব্বতের আকর্ষণ পর্যটকদের কাছে এতো অলঙ্ঘনীয়, অমোঘ, হাজার বছর ধরে সে আছে ভ্রমণপিপাসুদের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে! মনটা একটু ভারই ছিল শেষ পর্যন্ত মাত্র একজনের স্পন্সরের টাকা জোগাড় হওয়ায় নিজের টাকাটা পুরোপুরি মানিব্যাগ থেকেই দিতে হচ্ছিল ( টাকার অঙ্ক জানার দরকার নেই, কিন্তু যেহেতু ৮০০০ মিটারের যে কোন পর্বতই অত্যন্ত ব্যয়বহুল, শুধু জানিয়ে রাখি ঐ এক পর্বতে ব্যয়কৃত অর্থ দিয়েই সমগ্র দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকা ঘোরা হয়ে যায়) , কিন্তু তিব্বতের এমন আদিগন্ত বিস্তৃত রূপশোভা দেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত কেবল মনে হয়েছে ভাগ্যিস গিয়েছিলাম তিব্বতে, না হলে এই ক্ষুদ্র মানবজীবন অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
সেই সাথে এত ভুললেও চলবে না যে কারণে পলিমাটি দিয়ে তৈরি আমাদের সুজলা সুফলা বাংলাদেশ যে কারণে এত উর্বর, সেই একই কারণে তিব্বত এত মরুময়, শুষ্ক! কারণটা, গিরিরাজ হিমালয়। এক বিশাল প্রাচীরের মত সীমানা আগলে দাড়িয়ে আছে তা, বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘ কোনমতেই সেই সুউচ্চ বাঁধা ডিঙ্গাতে পারে না, ফলশ্রুতিতে জীবনদায়ী বৃষ্টিপাত একতরফা ভাবে সবসময়ই পক্ষপাতিত্ব করে আমাদের দিকটাতে, গড়ে তোলে উর্বর ভূমি আর হিমালয় প্রাচীরের অন্য পাশে তিব্বত থেকে মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা থাকে শুষ্ক, রিক্ত।
পরের গন্তব্য গোটা পঞ্চাশেক বাড়ী আর হোটেলের এক ক্ষুদে জনপদ তিংরি, উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪২০০ মিটার, পশ্চিমে শত শত মাইল চলে গেছে তিব্বতের রূক্ষ মালভূমি আর পূর্ব দিগন্তে দৃষ্টি যাবার অনেক অনেক আগেই তা আটকে পড়ে সমগ্র বিশ্ব থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করা মাউন্ট এভারেস্টে!
তিংরির হোটেলের যে সদা তৎপর দিদিমা পাহারাদার থেকে শুরু করে হেসেলদারের কাজ পর্যন্ত করতেন তার শতভাজ পড়া মুখের রেখাগুলো বলে দেয় শতবর্ষের প্রান্তসীমায় পৌঁছে গেছেন এই কর্মঠ মহিলা। এ এক জিনিস আমরা দেখেছি হিমালয়ের অধিবাসীদের মাঝে- অদম্য প্রাণশক্তি, নির্মেদ শরীর, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রমরত। সেখানে লাঠি অবলম্বনরত কাউকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। অনেকের হাতেই একমাত্র সম্বল জপমালা বা জপযন্ত্র।
তবে তিতিবিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম সেখানকার খাবারে, তিব্বতিদের প্রধান খাবার চমবা( গম ও যবের সমন্বয়ে তৈরি) আমাদের দেওয়া হত না, পাতে পড়ত মাত্রাতিরিক্ত তেলে ভাজা সবজি, ডিম, কখনো ইয়াকের মাংস। সেই রান্নায় না ছিল কোন নুন, না কোন ঝাল!
শেষে তিংরি বাজারে অবস্থিত এক নামকাওয়াস্তে নেপালি রেস্তোরাঁ ছিল অকূল পাথারে শেষ ভরসা। সেখানকার বাজারগুলোতে যেন ধুলো সবসময় থৈ থৈ করছে, কসাইয়ের দোকানে ঝোলানো ভেড়া বা ইয়াকের মাংসে ধুলোর পুরু আস্তরণ, তিব্বতিদের শরীরেও তাই, এমনিতেই আবার তাদের নামে দুর্নাম আছে স্নান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকার।
স্থানীয়রা অনেকেই ছবি তুললে টাকা দাবি করে। পথে এক ক্যাম্পের তত্বাবধানকারী মহিলা আমার গলায় ঝোলানো বাংলাদেশের গামছাটি খুব পছন্দ করাই একটি চমৎকার টুপির সাথে বিনিময়ের প্রস্তাব দেয়, আমিও সেই প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করি তবে সেই লোমশ টুপির বদলে নয়, তার দুটি ছবি তোলার অনুমতির বিনিময়ে।
তিব্বতের প্রায় ৮০০ জনবসতির আরো কয়েকটি ঘুরে আমরা রওনা দেয় গন্তব্যের পানে, সুউচ্চ পর্বত শিখরে। পথে দেখা মিলল এক ঝাক লামাগায়ারের সাথে, অদ্ভুত এক ভয়াল বুনো সৌন্দর্যের অধিকারী সরাসরি হাড় খাওয়ার ক্ষমতাধারী পাখিরাজ্যের একমাত্র বিস্ময় এই দাড়িওয়ালা শকুন। তার সুষমামণ্ডিত উড়াল যে কোন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানকেও হার মানাবে। ওরা মনে হয় উপর থেকে হাড় ফেলে ভাঙ্গার জন্য পাথুরে চাতাল খুঁজছিল। আরো দেখা হয় ইদুর জাতীয় প্রাণী পাইকা, বিশালাকার সোনালী ঈগল আর হঠাৎ করেই সামনে আসা পাহাড়ি অ্যান্টিলোপের পালের সাথে।
আবহাওয়া ভাল থাকাই সফল অভিযান শেষে অনুমিত সময়ের বেশ কদিন আগেই লোকালয়ে ফিরি আমরা, হাতে সময় থাকায় মন রোমাঞ্চে ভরে ওঠে লাসায় অবস্থিত দালাই লামার পোতালা প্যালেস ও বাচ্চাবেলার স্বপ্ন মানস সরোবর দেখার সম্ভাবনায়। কিন্তু গুড়ে বালি দিয়ে সাথের গাইড ও অন্যরা জানালো তিব্বতের ভিসার নিয়ম অত্যন্ত কড়া এবং জটিল। চীন সরকার আমাদের যে রাস্তা ও গন্তব্যের জন্য ভিসা দিয়েছে আমরা এর ব্যতিক্রম কোন ভাবেই করতে পারব না! কাজেই হাতে সময় থাকা স্বত্বেও এবারের মত ফিরতে হবে, মানস বা কৈলাস দেখতে চাইলে আবার আবেদন করতে হবে নতুন ভিসার। কোন গুম্ফা দেখার আশাও পরিত্যাগ করতে হল, ১৯৪৯ সালে তিব্বতে ছয় হাজারের উপর বৌদ্ধ মন্দির থাকলেও এখন হাতে গোনা, অতি সীমিত, রাস্তায় রাস্তায় লামা দর্শন হয় নি আমাদের, বরং এর চেয়ে বেশী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর সাথে পরিচয় ঘটে নেপালের রাস্তায়।
এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে কয়েক সপ্তাহের ভ্রমণ শেষে সীমান্তে ফিরি সবাই, তিব্বতের অনন্যসাধারণ ভূপ্রকৃতির প্রতি বিস্ময়ভরা মুগ্ধতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে।
মূল লিঙ্কঃ http://www.sachalayatan.com/node/41685
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন