১৪ নভে, ২০১১

আসর (সময়)

 এই ছোট্ট তিন আয়াতের সূরাটা সম্পর্কে লিখতে বসে কোথা থেকে শুরু করব ভেবে কূল কিনারা করতে পারছিনা। একবার মনে হচ্ছে যা শিখেছি সব লিখি, আবার ভাবছি যার আগ্রহ আছে সে তো নিজেই শিখে নিতে পারবে, বরং আমাদের জীবনে কীভাবে কাজে লাগাতে পারি তাই নিয়ে লিখি। আল্লাহর উপর সম্পূর্ণ ভরসা করে শুরু করলাম, জানিনা শেষ পর্যন্ত আল্লাহর আয়াতের কতটুকু মর্যাদা দিতে পারব।

কারো যদি সূরা আসর টা পড়া না হয়ে থাকে তার সুবিধার জন্য মোটামুটি একটা তর্জমা দিচ্ছি।

১. শপথ সময়ের (ওয়াল আসর)
২. নিশ্চয়ই প্রত্যেকটি মানুষ নিঃসন্দেহে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে (ইন্নাল ইনসানা লা ফী খুসর)
৩. শুধুমাত্র তারা ব্যতীত, যারা (ইল্লাল্লাযীনা)
- বিশ্বাস করেছে এবং (আ'মানু ওয়া)
- সৎকর্ম করেছে এবং (আ'মিলুস সালিহাতি ওয়া)
- উপদেশ দিয়েছে সত্যের দিকে / সততার সাথে এবং (তাওয়াসাও বিল হাক্ব ওয়া)
- উপদেশ দিয়েছে ধৈর্যের দিকে / ধৈর্যের সাথে (তাওয়াসাও বিস সাবর)

ছোট্ট সূরা। সিম্পল কথাবার্তা, কুরআনের অন্যান্য সব সূরায় যেমন সতর্কবাণী থাকে এখানেও তেমনই। কিন্তু এই সূরার
গঠন, পূর্ণাঙ্গতা, শব্দচয়ন সবকিছু চিন্তা করলে রীতিমত ভয় লাগে। প্রথমেই বলি, আল্লাহ কুরআনে অনেক বস্তু নিয়েই শপথ করেছেন, (যেমন সূরা ত্বীন, সূরা শামস্, সূরা আদিয়াত), শপথ নিয়ে শুরু করা সূরার ধারাবাহিকতায় শেষ সূরা হচ্ছে সূরা আসর, এর পরে আর কোন সূরায় আল্লাহ কোন কিছুর শপথ করে কিছু বলেন নি। তিনি কিসের শপথ নিলেন? সময়ের। কেন? সময়কে এত সম্মান কেন? কারণ প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে আল্লাহর দেয়া সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ সময়। ধনী হোক, গরীব হোক, অ্যাথলিট হোক, পঙ্গু হোক - সবার জন্য সময়ের দয়া সমান পরিমাণে আছে। একটা জিনিসের মূল্য আরো বেশি মনে হয় যখন জানি একে ধরে রাখা যাবেনা। দেশের বাইরে থেকে তিন সপ্তাহের জন্য দেশে বেড়াতে গেলে এর মর্ম আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। আল্লাহ সেই সময়ের শপথ করেছেন, ওয়াল আসর - যেখানে আসর এর শব্দগত উৎপত্তি 'আসীর' বা ফলের রস থেকে, নিংড়ে বের করতে গেলে যাকে কখনোই হাতের মুঠোয় ধরে রাখা যায়না।

এই আসর বা সময় শুধু সদা প্রবহমান - এটা বুঝাতেই ওয়াল আসর বলা হয়নি। আসর সাক্ষ্য দিচ্ছে যে প্রত্যেকটি মানুষ সত্যি সত্যি ক্ষতিগ্রস্ত। সময় একইসাথে গতিশীল, কিন্তু মহাকালের বিবেচনায় সবটুকু মিলিয়ে স্থানুও বটে। আমাদের হাসি খেলা, ইঁদুর দৌড়, পরষ্পরকে দোষারোপ, সামান্য অর্জনে আস্ফালন - তারপর একদিন নিরবে প্রস্থান - সব কিছুর সাক্ষী হয়ে আছে সময়। যে একই সাথে ছোট্ট শিশুর মত চঞ্চল, আবার শতবর্ষী ঋষির মত গম্ভীর। ইতিহাসের পাতার অসংখ্য সফল জাতির উত্থান ও পতন সময় দেখেছে, দেখেছে খুব সফল জননেতাকেও মৃত্যুর পরে ধূলোয় মিশে যেতে। আমাদের এত আয়োজন, এত আত্মম্ভরিতা - কিছুই সময়কে টানেনা, কারণ সে জানে এর শেষ হবে একটু পরেই।

এটা খুব অবাক করা ব্যাপার, আল্লাহ প্রত্যেকটা মানুষকে এত বড় একটা জিনিসের শপথ করে বলল ক্ষতিগ্রস্ত? আল্লাহ ইনসান না বলে কাফির বলতে পারত! মুশরিক বলতে পারত! ইনসান কেন? ইনসান দিয়ে ত বোঝায় পুরো পৃথিবীতে যত মানুষ আছে, বা যারা আগে চলে গেছে তাদের প্রত্যেকে আলাদা আলাদা করে। আমার ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান সব স্টুডেন্ট কে ডেকে যদি বলে, নূসরাত, you r in deep trouble, জেসি, you need to be careful, মমতা..., মারলন..., ব্রায়ান..., ক্যাথি - তাহলে যেমন ভয়ে আমাদের সবার আত্মা উড়ে যাবে, ইনসান ততটাই স্পেসিফিক। তাও একবার না, 'ইন্না' আর 'লা' একই বাক্যে দু দুটো অব্যয় ব্যবহার করে বাক্যটাকে খুবই জোরালো করা হয়েছে। প্রথমে 'আসর' দিয়ে শপথ, এক এক করে সবার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ, তারপর 'ইন্না' আর 'লা' দিয়ে এর গুরূত্ব দশ পনের গুণ বাড়িয়ে দেয়া - এই সূরায় আল্লাহ যেন মানুষের জন্য এক্সট্রিম এক্সট্রিম সতর্কবাণী দিয়েছেন।

আল্লাহ বললেন আমরা সবাই খুসর এর মধ্যে আছি। খুসর বলতে কিন্তু ছোটখাট ক্ষতি বোঝায় না। ব্যবসা করতে নেমে মূলধন সহ খুইয়ে নিঃস্ব হওয়া হচ্ছে 'খুসর।' আপনার পাঁচতলার ফ্ল্যাটে আগুনে আটকা পড়া হচ্ছে খুসর। অজ্ঞান অবস্থায় পানিতে পড়া খুসর। মোদ্দা কথা, সারভাইভাল এর প্রশ্ন যেখানে, যেখানে এই ক্ষতি থেকে উদ্ধার পাওয়া ছাড়া আর সব কিছু গৌণ হয়ে যায় - তাই খুসর। আল্লাহ কেন বললেন আমাদের জীবন নিয়ে টানাটানি? তিনি কি দেখেন না, আমরা দিব্যি বেঁচে বর্তে আছি? আমরা ত শেষ দিবসে বিশ্বাস করি, আর সাধ্যমত ইবাদত ও করি। তাহলে কেন তিনি ঘোর নাস্তিক এর সাথে আমাদের একই কাতারে ফেললেন?

উত্তর একটাই। সময়। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে তাদের থেকে কমিটমেন্ট নিয়েছেন যে তারা নিজেদের 'আক্বল' বা ইন্টেলেক্ট ব্যবহার করে স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে আল্লাহর পছন্দসই কাজ করবে। আমরা পৃথিবীতে কতসময় থাকব সেটা অনেক আগেই ঠিক করা। এসময়টায় কী করব সেটাও হলফ করে আল্লাহর কাছে বলে এসেছি। ভাবতে গেলে মনে হয় সময়টাই যেন আমাদের একটা টুল। আল্লাহর কাছে প্রতিজ্ঞা করে ধার নিয়ে এসেছি। আল্লাহ দেখছেন তাঁর এই অনুগ্রহের কী সদ্ব্যবহার আমরা করছি। অনেকটা এমন, আমরা একটা বিশাল বালিঘড়ির নিচের অংশে আছি। একটা একটা করে বালি উপর থেকে পড়ছে, কথা ছিল তাই দিয়ে আমরা আল্লাহর নাম গুলি লিখব। কিন্তু সব ভুলে তাই দিয়ে আমরা ঘর বাড়ি বানাচ্ছি, ছাদটাকে ছোঁয়ার সিড়ি বানাচ্ছি। আল্লাহ সব দেখছেন, আমাদের মনে করিয়ে দেয়ার জন্য রাসুল পাঠাচ্ছেন, তাঁরা কাঁচের দেয়ালের বাইরে থেকে বারবার আমাদের নিষেধ করছেন, আমরা ফিরেও তাকাচ্ছিনা। বালিঘড়ির শেষ বালিটা যখন তার যাত্রা শেষ করবে, জীবনের দীপটা নিভে যাবে, আল্লাহর সামনে দাঁড়াব নতমুখে, তখন আমাদের হয়ে সাক্ষ্য দেবে আমাদেরই তৈরি বালির ঘর, নষ্ট করা সময়।
 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

bdnews24.com - Home

ইরান বাংলা নিউজ

বিবিসি বাংলা

দৈনিক সংগ্রাম