
দুর্গ মানেই পাইক বরকন্দাজ, গোলা বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ, অস্ত্রের ঝনঝনানি। দুর্গ মানেই গুপ্তচর, সৈন্য, সেনাপতি, শোষণ-শাসন, ক্ষমতার চক্রান্ত। কিন্তু রূপকথা আসলেই দুর্গ আসবেই অবধারিত ভাবে, থাকবে সেখানে বন্দী দীঘল কেশের রাজকন্যা, না হয় ঘোড়া দাবড়ানো রাজকুমার, কখনো রক্তচোষা প্রেতাত্মা। কিন্তু এমন দুর্গ কি থাকতে নেই যা হবে এক আসল রূপকথার রাজ্য! কেবলই কোমল, সুন্দর, মোহময়তার স্থান সেখানে, নেই কোন অস্ত্রাগার, প্রহরীর টহল দেবার জায়গা, পালাবার গুপ্ত পথ, পাল্টা আক্রমণ চালাবার নানা ব্যবস্থা। হবেই বা না কেন, এমন দুর্গ কিন্তু একটি হলেও আছে আমাদের গ্রহে। নামেই দুর্গ কিন্তু ভেতরে বয়ে চলে কল্পলোকের সাথে পাল্লা দিয়ে বাস্তবের স্থাপনা, নকশা, কারুকার্য। এ যে রূপকথার দুর্গ, মিছি মিছি নয়, সত্যিকারের আসল রূপকথা! সঙ্গী হবেন নাকি বন্ধুরা কল্পনা ও বাস্তবতার সেই মিলন স্থলে—বাভারিয়ার নইসোয়ানস্টাইন দুর্গে!

অনেক অনেক দিন আগে এক দেশে ছিল এক রাজা, অবধারিত ভাবেই পরমা সুন্দরী রানী ও তাদের দুই রাজপুত্র। সেই দেশটি পাহাড় ঘেরা, সবুজ বন ছাওয়া, সুনিবিড় শান্তিতে মোড়া। রাজ্যের নাম বাভারিয়া, বর্তমানের জার্মানিতে অবস্থিত এই আলপাইন ভূখণ্ডের বড় রাজপুত্র ল্যুদভিগ ( ২য়) খুব অন্য ধরনের মানুষ, আর দশজনের মত শাসন, অর্থ, রাজ্য নিয়ে মত্ত না থেকে তার খেয়ালী মন মেতে ছিল নিজের সৃষ্ট কল্পরাজ্যে, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে নয়, সঙ্গীতের মূর্ছনায়ই জীবনের রাজা হবার সার্থকতা খুঁজে পেতেন তিনি। ও বলা হয় নি, বাবার মৃত্যুর পর ১৮৬৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাভারিয়ার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন আমাদের রূপকথার রাজা,যার আরেক নাম ছিল রাজহংস রাজ! তার পরপরই তিনি মেতে ওঠেন আপন মনের গহন থেকে উঠে আসা ধারনা নিয়ে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে। সেই সময়ের বিখ্যাত সুরকার রিচার্ড ভ্যাগনার ছিলেন তার অতি আপনজন, নিজের রচিত অপেরা দিয়ে মুগ্ধ রাজচিত্ত এতটাই বিমোহিত করেছিলেন ভ্যাগনার যে রাজা ল্যুদভিগ বন্ধুর রচিত এক অপেরাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে মহাকালের বুকে অক্ষয় করে রাখবার মানসে এক দুর্গ গড়ার পরিকল্পনা করেন, যা হবে আনন্দ-উচ্ছাসের সূতিকাগার। সেই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু হয় তার সিংহাসনে বসার পরপরই ১৮৬৯ সালে, চলে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত, এবং এখন পর্যন্ত রাজার কল্পিত মূলনকশা অনুযায়ী কাজ আর সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয় নি। এই সেই নইসোয়ানস্টাইন দুর্গ।

এমন খেয়ালি শাসকের কথা শুনলে অবশ্য একটু বিরক্তই লাগে, জনগণের কষ্টের ফসল বিনা আয়েশে তারা বিলিয়ে দেয় ভোগলীলায়, আগ্রার তাজমহল থেকে শুরু করে মিশরের পিরামিড- কোন রাজকীয় স্থাপনা এই নিয়মের ব্যতিক্রম! কিন্তু আমাদের রাজা ল্যুদভিগ এদিক দিয়েও ছিলেন অনন্য, সম্পূর্ণ নিজের উপার্জন দিয়ে এই খেয়াল চরিতার্থ করে ছিলেন তিনি, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে লুণ্ঠন করে নয়। সুবিশাল কর্মযজ্ঞের এক পর্যায়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ ঋণ করতে বাধ্য হন তিনি, তারপরও জনগণের করের টাকায় হাত দেন নি কখনোই, বরং এই উচ্চাভিলাষী স্থাপনার কাজ সম্পূর্ণ হবার আগেই প্রায় দেউলিয়া হয়ে পড়েন রাজা নিজেই! এমন তথ্যগুলো পাবার পর স্বাভাবিক ভাবেই রাজার প্রতি একটা টান চলে এসেছিল,মানুষতো ভাবেই সবসময়, আমি যদি রাজা হইতাম, তয়লে খবর আছিল! কিন্তু সত্যিকারের কজন রাজা এমন কাজ করতে পারে?

সেই সাথে জানলাম অনেক বছর ধরেই বিশ্বের সুন্দরতম দুর্গের স্বীকৃতি এই বিশেষ দুর্গটির দখলে,ওয়াল্ট ডিজনির স্লিপিং বিউটি কার্টুনে কিন্তু আমাদের এই রূপকথার দুর্গের মডেলই হুবহু ব্যবহার করা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে বাভারিয়া ভ্রমণের সময় অবশ্য গন্তব্যের তালিকায় ছিল এই মুগ্ধ বিস্ময়।

ছবির মত সাজানো শহর ফুসেনের আস্তানা থেকে মাত্র মাইল দূরেই আমাদের গন্তব্য। কিন্তু দর্শনার্থীদের অতিরিক্ত ভিড়ের কথা চিন্তা করেই একটু সকাল সকাল কুয়াশা শরীরে মাখতে মাখতে পাহাড়ী পথ বেয়ে চললাম নগর কেন্দ্রের দিকে। প্রথমেই টিকেট কাটতে হলদে দুর্গ শ্লস হোয়েনসোয়াংগাঁওয়ের, যার নির্মাতা ছিলেন আমাদের আজকের গল্পের রাজা ল্যুদভিগের বাবা রাজা ২য় ম্যাক্সমিলান, এখানেই কেটেছিল ল্যুদভিগের স্বপ্নাচ্ছন্ন কৈশোর।


যে প্রাচীন দুর্গের ভিত্তির উপরে এই হলদে দুর্গ নির্মিত তা ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর! ম্যাক্সমিলান ১৮২৯ সালের এপ্রিলের এক বিকেলে পদব্রজে নিসর্গ উপভোগের সময় সেই ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কার করেন এবং সেই স্বপ্ন ঘেরা প্রকৃতিতে নিজস্ব আবাস গড়ার চিন্তায় নিবিষ্ট হয়ে পড়েন, যার ফলাফল এই দুর্গ। এটি মূলত ছিল রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন ও শিকারকালীন আবাস।

এখানে কিছুক্ষন প্রাসাদের নানা ঘর দেখতে দেখতে গাইডের চোস্ত বয়ানে শোনা গেল অত্র অঞ্চলের ইতিহাস ও রাজার ঠিকুজি।

এরপরে শরতের ঝরা পাতা বিছানো রাস্তা ধরে পাহাড়ের উপর দিকে রূপকথার দুর্গের পানে। পথে ঘুমন্ত এক পাহাড়ি হ্রদ দেখা দিল অনন্য রূপে, মৃদু আলোয় কুয়াশার চাদর যেন জলস্থলের ভেদাভেদ ভুলিয়ে দিল, এমন স্থানেই বুঝি পৃথিবীকে মায়াবীর নদীর পাড়ের দেশ বলে ভ্রম হয়।

হ্রদের তীরের মোহময়ী এক ভাসমান ঘর দেখে প্রশান্ত মন বলে উঠল থেকে যাও এই খানেই বাকী সারা জীবন! কি হবে এই নগর জীবনের ব্যস্ততার অংশ হয়ে, এখানে মাদুরে বসে অবলোকন করবে বিশুদ্ধ প্রকৃতি, মাঝে সাঝে রচিত হবে গোটা দুই হাইকু, এর চেয়ে বেশী কি পাবার আশা করা যায় এই শিশিরবিন্দুর মত ক্ষণস্থায়ী জীবনে?

দেখা মিলল তার জনাকয়েক স্থানীয় বাসিন্দাদের, যারা প্রমাণ করে ছাড়ল এই গাঁয়ের নামকরণের সার্থকতা! সোয়াংগাঁওর মানেই তো রাজহাঁসের এলাকা !

বেশ রাস্তাটি! কেমন নিস্তব্ধ নিঝুম! শীতের আগমনী বার্তা শোনালেও শরতের রঙ ঝলমলে পাতায় দশদিক উদ্ভাসিত। এর ফাকে গাছের আড়ালে দৃষ্টিসীমায় প্রথমবারের মত আসে স্বপ্নের সেই স্থাপনা!

খানিক পরেই আরো নিকটবর্তী হয় আমরা ,বিস্ময়াভূত হয়ে মনে হয় ডিজনির অ্যানিমেশনের জগতে চলে এসেছি সবাই এই বাভারিয়ার পর্বতে।


ধবধবে সাদা দেয়ালের উপরে অসংখ্য সুউচ্চ কালো কালো মিনার। সবার আগে দৃষ্টি আটকে যায় চমৎকার ভাবে সাজানো বিশালাকার সিংহতোরণে।

হাজারো বিমুগ্ধ পর্যটকের দলে ভিড়ে অবশেষে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশের সুযোগ মিলল বেশ খানিকক্ষনের অপেক্ষার পর। এখানে নেই কোন কামান, নেই কোন বন্দুক, যেমন ল্যুদভিগের মনোজগতে ছিল না কোন বিধ্বংসী চিন্তার ঠাই, চারপাশেই কেবল সুরঝংকারের মূর্ছনায় মাতানো স্থাপনার ছড়াছড়ি।

সেই সাথে বহু বর্ণে রাঙানো প্রতিটি দেয়াল, মেঝে, ছাদ! ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ বিধায় গোপনে কিছু মুহূর্ত কেবল ফ্রেমবন্দী করেছি অনেক কসরতের পর।




তবে মুক্ত এক বারান্দা থেকে চির উন্নত মম শির বাভারিয়ার বিখ্যাত পর্বত শ্রেণীর শোভা দেখার সাথে সাথে শ্যাটার টিপতে ভুল হয়নি মোটেই।


জানা গেল ল্যুদভিগের মূল পরিকল্পনায় এই দুর্গপ্রাসাদে ২০০ কক্ষের পরিকল্পনা থাকলেও আদতে মাত্র ১৫টি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়, যা দেখেই বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আজও সেই অবাক করা সৌন্দর্য ও মানুষের কল্পনাশক্তিতে হতবাক হয়।

রাজার জন্য নির্ধারিত বিছানার ঠিক উপরের ছাদে সেই সময়ে নানা পাইপ ও চকচকে ধাতব পদার্থ ও অন্যান্য বস্তুর সাহায্যে এমন আকৃতি দেওয়া হয়েছে যাতে মনে হয় তারাজ্বলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে আছেন তিনি। অদ্ভুত ব্যাপার হল হালফ্যাশনের অনেক বাড়িতেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করে রাতের এক টুকরো আকাশকে সৃষ্টি করা হয় ঘুমঘরের অভ্যন্তরে।
আজীবন অকৃতদার এই খেয়ালি রাজাকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে মানসিক রোগী আখ্যা দিয়ে ১৮৮৬ সালের জুন মাসে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ও মিউনিখের দক্ষিণের স্ট্রানবার্গ হ্রদের তীরে অবস্থিত দুর্গে পর্যবেক্ষণের জন্য আনা হয়, এর মাত্র কয়েকদিন পরেই ব্যক্তিগত চিকিৎসকসহ রূপকথার রাজা ল্যুদভিগ অত্যন্ত রহস্যজনক ভাবে সেই হ্রদের অগভীর জলে মৃত্যুবরণ করেন। ঠিক কি ভাবে তিনি এই জগৎ থেকে চিরতরে বিদায় নিয়েছিলেন তার উপর আলোকপাত আজ পর্যন্ত করা সম্ভব হয় নি কিন্তু এককালের পাকা সাঁতারু ল্যুদভিগ যে কোমর গভীরতার জলে আরেক জন পূর্ণ বয়স্ক মানুষসহ ডুবে মারা যাবেন এই কথা বিশ্বাস করার লোক কোন কালেই ছিল না! যদিও সরকারি নথিতে একে আত্নহত্যা বলেই উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু ধারনা করা যায় প্রবল ক্ষমতাশালী কোন শত্রুই ছিল তার মাত্র ৪০ বছর বয়সে অকালমৃত্যুর কারণ।
নিয়তির পরিহাস হচ্ছে ক্ষমতা থেকে ল্যুদভিগকে সরানোর মূল কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল তার এই সমস্ত অদ্ভুত শখ রাজ্যের অর্থনীতিতে বিপর্যয় ডেকে আনছে (যদিও এগুলো তার ব্যক্তিগত তহবিলের) অথচ আজ বাভারিয়া অঞ্চলের অন্যতম উপার্জন হয় সেই খেয়ালি স্বপ্নবিলাসী রাজারই নির্মিত নানা স্থাপনা থেকে।

দুর্গের নানা অংশ ভ্রমণ শেষে বাহিরের চত্বরে এসে দাড়ায় সবাই,

দূরে পরিখার উপরে নয়নাভিরাম এক ঝুলন্ত সেতুর উপরে আগন্তকদের ভিড় দেখে জানতে পারি সেখান থেকেই নইসোয়ানস্টাইন দুর্গের সমস্ত পোস্ট কার্ড ছাপাবার মত ঝকঝকে ছবি তোলা যায়।


নানা চড়াই উৎরাই বেয়ে সেই সেতুর ওপর পৌছালাম বটে কিন্তু ততক্ষণে পাহাড়ি উপত্যকায় আচমকা হানা দেওয়া মেঘের দল আমাদের করে ফেলেছে সমগ্র গ্রহ থেকে বিচ্ছিন্ন। এত কাছের যে বিশাল দুর্গ তার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না ঘন মেঘের ভেলার আড়ালে!

আফসোস না বাড়িয়ে এই অপূর্ব রূপকথার জগতকে কাছে থেকে দেখার সুখস্মৃতি নিয়ে পা বাড়ালাম ফুসেনের দিকে।

( প্রিয় বন্ধুরা, আমাদের বাভারিয়া অবস্থানের দিনগুলোতে অক্টোবরের আকাশ পুরোটাই মুখ ঢেকে রেখেছিল মেঘ আর কুয়াশার চাদরে, যার কারণে নইসোয়ানস্টাইন দুর্গের পুরো ছবি তোলা সম্ভব হয় নি, তাই নেট থেকে খুজে পেতে কিছু ছবি দিলাম আপনাদের জন্য, দুর্গের ভিতরের ৩টি ছবি উইকি থেকে নেওয়া, বাকিগুলো আমারই একটু চিকনে তোলা !)
সুত্রঃhttp://www.sachalayatan.com/tareqanu/41977
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন